চরম অস্তিত্বসঙ্কটে হিমালয়, একের পর এক বিপর্যয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে ফের তীব্র ভর্ৎসনা সুপ্রিম কোর্টের

হিমালয় সংলগ্ন ভারতীয় রাজ্যগুলিতে ক্রমবর্ধমান পরিবেশগত বিপর্যয় এবং অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের কারণে সৃষ্ট অস্তিত্বসঙ্কট নিয়ে আবারও তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করল দেশের সর্বোচ্চ আদালত। একের পর এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে…

Riddhi Datta

 

হিমালয় সংলগ্ন ভারতীয় রাজ্যগুলিতে ক্রমবর্ধমান পরিবেশগত বিপর্যয় এবং অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের কারণে সৃষ্ট অস্তিত্বসঙ্কট নিয়ে আবারও তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করল দেশের সর্বোচ্চ আদালত। একের পর এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে সাম্প্রতিক বর্ষায় হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডে ভূমিধস ও আকস্মিক বন্যার প্রেক্ষিতে কেন্দ্র এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলির নিষ্ক্রিয়তাকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। একটি জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে, শীর্ষ আদালত হিমালয়ের ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্র (fragile ecosystem) রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতাকে “চরম উদাসীনতা” বলে চিহ্নিত করেছে। এই সংকটজনক পরিস্থিতি, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকাকে বিপন্ন করে তুলেছে, তা নিয়ে নতুন করে দেশ জুড়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন, বিশেষ করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের দ্বিমুখী আক্রমণে হিমালয়ের সহনশীলতা তার শেষ সীমায় পৌঁছেছে। এর ফলস্বরূপ, ভূমিধস, হিমবাহ হ্রদ ফেটে আকস্মিক বন্যা (GLOF), এবং যোশীমঠের মতো ভূ-অবনমন (land subsidence) এখন এক ভয়াবহ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ শুধুমাত্র একটি আইনি তিরস্কার নয়, বরং এটি একটি জাতীয় নীতি নির্ধারণের জরুরি আহ্বান।

এক নজরে মূল তথ্য (Key Facts)

  • সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ: হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করতে সরকারের ব্যর্থতাকে “চরম উদাসীনতা” বলে উল্লেখ করেছে সর্বোচ্চ আদালত। আদালতের মতে, পরিবেশ আইন এবং বিশেষজ্ঞদের সুপারিশকে উপেক্ষা করেই একের পর এক প্রকল্পকে ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে।
  • সাম্প্রতিক বিপর্যয়: ২০২৩ সালের বর্ষায় হিমাচল প্রদেশে ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধসে ৫০০-র বেশি মানুষের মৃত্যু হয় এবং প্রায় ১২,০০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয় (সূত্র: দ্য হিন্দু)। এই বছরও বর্ষার শুরুতেই উত্তরাখণ্ড এবং সিকিমে একাধিক ছোট-বড় ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে।
  • বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট: হিমালয় অঞ্চলের ১৩টি রাজ্যের ‘ধারণ ক্ষমতা’ (carrying capacity) মূল্যায়নের জন্য কেন্দ্রকে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এই কমিটি প্রতিটি हिल स्टेशन-এর জনসংখ্যা ও পরিকাঠামোর ভার বহনের ক্ষমতা নিরূপণ করবে। (সূত্র: লাইভ ল)
  • বৈজ্ঞানিক তথ্য: ২০২১ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, হিন্দু কুশ হিমালয় অঞ্চলের প্রায় ৬৫% হিমবাহ ২০৫০ সালের মধ্যে গলে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, যা এই অঞ্চলের নদীগুলির জলপ্রবাহ এবং কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করবে। (সূত্র: ICIMOD)
  • মানবিক সংকট: শুধুমাত্র যোশীমঠেই ৬০০-র বেশি বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে এবং শত শত পরিবারকে তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়েছে। এই ঘটনা হিমালয়ের অন্যান্য জনবসতিগুলির ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।

 কেন হিমালয় আজ বিপন্ন?

ভারতীয় হিমালয় অঞ্চল (IHR) প্রায় ১৩টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত এবং দেশের মোট ভৌগোলিক এলাকার প্রায় ১৬% জুড়ে রয়েছে। এটি শুধুমাত্র একটি পর্বতমালা নয়, এটি ভারতের জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য এবং কোটি কোটি মানুষের জলের উৎসের নিয়ন্ত্রক। কিন্তু গত কয়েক দশকে, “উন্নয়ন”-এর নামে এখানে যে ব্যাপক পরিকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়েছে, তা এই অঞ্চলের ভঙ্গুর পরিবেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মূল কারণগুলি হল:

  • অবৈজ্ঞানিক নির্মাণ: রাস্তা, সুড়ঙ্গ, এবং বড় বড় বাঁধ নির্মাণের জন্য পাহাড় কাটার সময় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ না করা।
  • বনভূমি ধ্বংস: ব্যাপক হারে গাছ কেটে ফেলার ফলে মাটির জলধারণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, যা ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে।
  • অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন: জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি পর্যটকদের ভিড় এবং তার জন্য তৈরি হওয়া হোটেল, রিসর্টগুলি পাহাড়ের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে।
  • জলবায়ু পরিবর্তন: বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে হিমবাহগুলি দ্রুত গলছে, যার ফলে হিমবাহ হ্রদ ফেটে বিপর্যয় (GLOF) এবং আবহাওয়ার চরম ভাবাপন্নতা বাড়ছে।

সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান ও তথ্য

হিমালয়ের সংকট যে কতটা গভীর, তা কিছু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট।

  1. দুর্যোগের সংখ্যাবৃদ্ধি: ভারত সরকারের ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, শেষ দশ বছরে (২০১৫-২০২৪) হিমালয় সংলগ্ন রাজ্যগুলিতে ভূমিধস এবং আকস্মিক বন্যার ঘটনা আগের দশকের তুলনায় প্রায় ৩০০% বৃদ্ধি পেয়েছে। (সূত্র: National Disaster Management Authority, India)
  2. হিমাচলের ক্ষয়ক্ষতি (২০২৩): হিমাচল প্রদেশ সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলা বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুলাই এবং আগস্ট মাসে রাজ্যে মোট ১১৮টি বড় ভূমিধস এবং ৭২টি আকস্মিক বন্যার ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় ২,২৩৫টি বাড়ি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায় এবং প্রায় ১০,০০০ বাড়ি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (সূত্র: HP State Disaster Management Authority)
  3. উত্তরাখণ্ডের পরিস্থিতি: দেরাদুনের ওয়াদিয়া ইনস্টিটিউট অফ হিমালয়ান জিওলজি-র একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, উত্তরাখণ্ডের চামোলি এবং পিথোরাগড় জেলার প্রায় ২৫% এলাকা ভূমিধস-প্রবণ অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। এই সমীক্ষাটি ২০২২ সালের এবং এর পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। (সূত্র: Wadia Institute of Himalayan Geology)

শীর্ষ আদালতের হস্তক্ষেপ ও সরকারের প্রতিক্রিয়া

এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি, সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ডি.ওয়াই. চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ কেন্দ্রকে সরাসরি প্রশ্ন করে যে, হিমালয়ের “ধারণ ক্ষমতা” নির্ধারণের জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

আদালত বলেছে, “আপনারা শুধুমাত্র একটি বিপর্যয় ঘটলে জেগে ওঠেন। কিন্তু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কোথায়? প্রত্যেকটি हिल स्टेशन-এর একটি নির্দিষ্ট ভার বহনের ক্ষমতা আছে। আপনারা সেই সীমা লঙ্ঘন করে চলেছেন।” (সূত্র: সুপ্রিম কোর্টের মৌখিক পর্যবেক্ষণ, লাইভ ল-এ প্রকাশিত)

এর প্রতিক্রিয়ায়, কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক (MoEFCC) আদালতকে জানিয়েছে যে, তারা সমস্ত হিমালয় রাজ্যকে তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের ‘ধারণ ক্ষমতা’ সমীক্ষা করার জন্য নির্দেশিকা পাঠিয়েছে। তবে, এই প্রক্রিয়া কবে শেষ হবে বা তার ভিত্তিতে কী কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ

পরিবেশ বিজ্ঞানী ডঃ রবি চোপড়া, যিনি চারধাম সড়ক প্রকল্পের উপর সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত উচ্চ পর্যায়ের কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, তাঁর মতে, “সরকার বৈজ্ঞানিক পরামর্শকে लगातार উপেক্ষা করে চলেছে। আমরা চারধাম প্রকল্পের বিস্তারের বিরুদ্ধে বারবার সতর্ক করেছিলাম, কারণ এটি এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য বিপজ্জনক। যোশীমঠের ঘটনা তারই একটি উদাহরণ মাত্র।” (সূত্র: দ্য ওয়্যার-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকার থেকে সংকলিত)

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন যে, শুধুমাত্র সমীক্ষা বা নির্দেশিকা জারি করাই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন একটি সামগ্রিক হিমালয় নীতি (National Mission for Sustaining the Himalayan Ecosystem), যা উন্নয়ন এবং পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করবে। এই নীতিতে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ এবং ঐতিহ্যগত জ্ঞানের প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি।

সাধারণ মানুষের উপর প্রভাব

এই পরিবেশগত সংকটের সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছেন হিমালয়ের সাধারণ মানুষ। কৃষিকাজ, পশুপালন এবং পর্যটনের উপর নির্ভরশীল লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনযাত্রা আজ বিপন্ন।

উত্তরাখণ্ডের রাইনি গ্রামের একজন বাসিন্দা, ৬৫ বছর বয়সী মঙ্গলী দেবী বলেন, “আমাদের চোখের সামনে নদী সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়গুলো কাঁপছে। আমাদের পূর্বপুরুষরা এখানেই থাকতেন, কিন্তু এখন আমাদের বলা হচ্ছে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে। আমরা কোথায় যাব?” (সূত্র: গ্রাউন্ড रिपोर्ट, স্ক্রোল.ইন)

এই বিপর্যয় শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষতি বা পরিকাঠামোর ধ্বংসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এটি একটি গভীর সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সংকটও তৈরি করছে।

পরবর্তী পদক্ষেপ: কী আশা করা যায়?

সুপ্রিম কোর্টের কড়া মনোভাবের পর কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলি কিছুটা চাপের মধ্যে রয়েছে। আগামী দিনে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির উপর নজর থাকবে:

  • বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট: আদালত নির্দেশিত ‘ধারণ ক্ষমতা’ মূল্যায়ন কমিটির রিপোর্ট এবং তার সুপারিশগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।
  • নীতিগত পরিবর্তন: সরকার কি শুধুমাত্র तात्कालिक ব্যবস্থা নেবে, নাকি একটি দীর্ঘমেয়াদী এবং বিজ্ঞানসম্মত ‘হিমালয় নীতি’ প্রণয়ন করবে?
  • আইনের প্রয়োগ: পরিবেশ সুরক্ষা আইন (EPA, 1986) এবং বন সংরক্ষণ আইন (FCA, 1980) কতটা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

হিমালয় শুধুমাত্র পাথর, বরফ এবং নদীর সমষ্টি নয়, এটি ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আজকের এই অস্তিত্বের সংকট শুধুমাত্র একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি একটি জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ও বটে। সুপ্রিম কোর্টের ভর্ৎসনা যদি সরকারগুলির জন্য একটি চূড়ান্ত সতর্কবার্তা হিসাবে কাজ করে, তবেই হয়তো এই দেবভূমিকে বাঁচানো সম্ভব হবে। অন্যথায়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের এই চরম উদাসীনতার জন্য ক্ষমা করবে না।

 

About Author
Riddhi Datta

ঋদ্ধি দত্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি একজন উদীয়মান বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, যিনি জটিল বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলিকে সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য করে তোলেন। তাঁর লেখায় রসায়ন, পরিবেশ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সমসাময়িক বিষয়গুলি প্রাধান্য পায়। ঋদ্ধি নিয়মিতভাবে এই ওয়েবসাইটে বিজ্ঞান-ভিত্তিক প্রবন্ধ, গবেষণা সারসংক্ষেপ এবং বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেন।