Hindu families attacked in Bangladesh: বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হওয়া হিন্দু পরিবারগুলো আতঙ্কের মধ্যে তাদের ঘরবাড়ি থেকে জিনিসপত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। রংপুরসহ দেশের নানা প্রান্তে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বসতঘরে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনার পর স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাধ্য হচ্ছেন নিজেদের পৈতৃক ভিটেমাটি ছাড়তে। সোমবার সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, হামলার শিকার পরিবারগুলোর ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ লন্ডভন্ড অবস্থায় রয়েছে।
সম্প্রতি কটূক্তির অভিযোগে গ্রেপ্তার এক কিশোরের বাড়িসহ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ১৪টি বসতঘরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে রংপুরে। এই ঘটনার পর পুরো এলাকায় এমন এক আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যে অনেক পরিবার তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোপনে সরিয়ে নিয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। ঘটনার পর থেকেই এই পরিবারগুলো রাতের আঁধারে কিংবা দিনের বেলা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তাদের মূল্যবান সামগ্রী ও জরুরি কাগজপত্র নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করার চেষ্টা করছেন।
যশোরেও অনুরূপ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, যেখানে অর্ধশত হিন্দু বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার পর ভয়ে অনেকেই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। উত্তর-পশ্চিম বাংলাদেশের ফারাবাড়ি মন্দিরপাড়া গ্রামেও একটি হিন্দু পরিবারের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে, যা রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ধারাবাহিক হামলার অংশ বলে মনে করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর থেকে শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্টের মধ্যে বাংলাদেশের নানা অংশে অন্তত ২,০১০টি সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এই ১৭ দিনে অন্তর্ভুক্ত সময়ে অন্তত ৬৯টি উপাসনাস্থল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যেগুলি সবই সংখ্যালঘুদের উপাসনাস্থল ছিল।
আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। ভারত সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ২৫ জানুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশে হিন্দুদের উপরে ৭৬টি হামলার ঘটনার রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে। গত বছরের আগস্ট মাস থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, এখনও পর্যন্ত ২৩ জন হিন্দু তাদের প্রাণ হারিয়েছেন এবং ১৫২টি মন্দিরের উপর হামলা চালানো হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ) তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দাবি করেছে যে, গত এক বছরে বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা কমেছে। তাদের মতে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ধারাবাহিক হামলার মধ্যে বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা হ্রাস পেয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, শেখ হাসিনার অপসারণের পরবর্তী সময়ে হিন্দু গোষ্ঠীগুলো তাদের সম্প্রদায়ের সদস্য ও মন্দিরের ওপর আক্রমণ ও ভাঙচুর বাড়ার দাবি করেছে।
সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে উত্তপ্ত মালদার মোথাবাড়ি, শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ বাহিনী মোতায়েন
তবে বাংলাদেশের পুলিশের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ৫ থেকে ২০ আগস্টের মধ্যে মোট ১,৭৬৯টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১,২৩৪টি রাজনৈতিক, ২০টি সাম্প্রদায়িক ও ১৬১টি ভুয়া অভিযোগের ভিত্তিতে সংঘটিত হয়েছে। পুলিশ দাবি করেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। যদিও তারা সরাসরি শিকার না হলেও, ক্রমাগত হামলা ও উত্তেজনার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা কাজ করছে। এই আতঙ্কের পরিবেশে অনেক পরিবার তাদের জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে পারছেন না এবং অনেকেই জীবিকার উৎস হারিয়ে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন।
এদিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা করার জন্য তাদের অভিপ্রায় প্রকাশ করেছে। সরকার জিরো টলারেন্স নীতি প্রয়োগ করে অভিযুক্তদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে। ২০২৪ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সরকার জানিয়েছিল, সংখ্যালঘুদের উপরে হামলার ৮৮টি ঘটনার প্রেক্ষিতে ৭০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলার মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। অনেক সময় পুরনো ঘটনার ভিডিও বা ছবি ব্যবহার করে নতুন হামলার দাবি করা হচ্ছে, যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থাগুলো এধরনের ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছে।
চলমান সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়াও ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি পরিবর্তন করে ‘বহুত্ববাদ’ অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেছে সংশ্লিষ্ট কমিশন। এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি, যারা ‘আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা’ শব্দবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে। ভারতের বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রি গত ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ সফরের সময় এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিয়ে ভারতের উদ্বেগের বিষয়টি বাংলাদেশকে জানানো হয়েছে এবং সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সম্পত্তির উপর হামলার মতো দুঃখজনক ঘটনা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের হিন্দু পরিবারগুলো যে আতঙ্কের মধ্যে বাস করছেন এবং তাদের ঘরবাড়ি থেকে জিনিসপত্র সরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন, তা একটি গভীর মানবিক সংকটের ইঙ্গিত দেয়। এই পরিস্থিতির দ্রুত সমাধান এবং সব ধর্মের মানুষের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারের পাশাপাশি সমাজের সকল স্তরের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।