আজ ৭ মার্চ। বাতাসে যেন একটি অদৃশ্য শক্তির ঢেউ খেলছে, যে ঢেউ একটি জাতির হৃদয়কে স্পন্দিত করে দিয়েছিল ১৯৭১ সালে। এই দিনটি শুধু একটি তারিখ নয়, এটি বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের একটি জীবন্ত স্মৃতি। যখন একজন মানুষের কণ্ঠ জাতির ভাগ্য বদলে দেয়, তখন সেই কণ্ঠ কেবল শব্দ নয়, একটি অমর কাব্য হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, আমাদেরকে সেই দিনের গৌরবময় মুহূর্তগুলোর স্মরণ করিয়ে দিতে। চলুন, সময়ের পাতা উল্টে ফিরে যাই সেই দিনে, যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল—“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ আমাদের জন্য একটি প্রেরণার দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। এই ভাষণ ছিল বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা। মাত্র ১৮ মিনিটের এই ভাষণে তিনি পাকিস্তানি শাসকদের শোষণের ইতিহাস তুলে ধরেন এবং বাঙালিদের মুক্তির জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। এই দিনটি শুধু একটি ভাষণের দিন নয়, এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা। বঙ্গবন্ধুর কথায় উদ্দীপ্ত হয়ে বাঙালি জাতি পরবর্তীতে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে। আজ আমরা এই দিনটির গুরুত্ব অনুভব করি, কারণ এটি আমাদের পরিচয় ও স্বাধীনতার ভিত্তি।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ” যে শূন্য থেকে শুরু হয়নি, তার পেছনে রয়েছে বছরের পর বছর শোষণ আর বঞ্চনার ইতিহাস। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পাকিস্তানের দুটি অংশ – পূর্ব ও পশ্চিম – একটি রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাঙালিরা তাদের মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিল। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরালো করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকরা এই দাবি মানতে অস্বীকার করে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে বাঙালিরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ২ ও ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের জনসভার ঘোষণা দেন। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই “Historic 7th March” আমাদের ইতিহাসে অমর হয়ে ওঠে।
৭ মার্চ, ১৯৭১। সকাল থেকে রেসকোর্স ময়দানে মানুষের ঢল নামে। প্রায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষ জড়ো হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। বিকেল ২টা ৪৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠেন। তাঁর কণ্ঠে যখন প্রথম শব্দ ধ্বনিত হয়, তখন পুরো ময়দান নিস্তব্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, “আমার উপরে যে মামলা দেওয়া হয়েছে, আমি গ্রেফতার হয়ে জেলে গিয়েছি, আমার জীবনের অর্ধেকটা জেলে কাটিয়েছি। তবুও আমি বাঙালির অধিকারের জন্য লড়াই করেছি।”
তিনি বাঙালির শোষণের কথা তুলে ধরেন – ভাষা আন্দোলনের শহীদদের কথা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কথা। তারপর তিনি পাকিস্তানি শাসকদের উদ্দেশে চারটি শর্ত দেন:
১. সামরিক আইন তুলে নিতে হবে।
২. সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরতে হবে।
৩. ক্ষমতা জনপ্রতিনিধিদের হাতে দিতে হবে।
৪. হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে হবে।
শেষে তিনি সেই অমর বাক্য উচ্চারণ করেন: “তোমাদের যার যা আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ।” ভাষণ শেষ হয় বিকেল ৩টা ৩ মিনিটে। এই ১৮ মিনিট বাঙালির জীবনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
জাতীয় শোক দিবস: ১৫ আগস্টের সরকারি ছুটির ইতিহাস
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে “জয় বাংলা” স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা দেশ। মানুষ বুঝতে পারে, এবার লড়াই অনিবার্য। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।” এই নির্দেশে বাঙালিরা প্রতিরোধের প্রস্তুতি শুরু করে। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তারপর শুরু হয় ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ, যার ফলে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। “Historic 7th March” ছিল এই স্বাধীনতার প্রথম সোপান।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতিকে এক সুতোয় বেঁধেছিল। ধনী-গরিব, ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক – সবাই একসঙ্গে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। তিনি শুধু স্বাধীনতার কথাই বলেননি, বরং কীভাবে প্রতিরোধ গড়তে হবে, তারও দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই ঐক্যই আমাদের শক্তি ছিল।
২০১৭ সালে ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে “Memory of the World Register”-এ অন্তর্ভুক্ত করে। এটি বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্যের মধ্যে স্থান পায়। এই স্বীকৃতি প্রমাণ করে যে, “ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ” শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্যও একটি আলোকবর্তিকা।
এই ভাষণ শুধু রাজনৈতিক ঘোষণা ছিল না, এটি বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। এটি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিখ্যাত কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন, “এটি একটি কাব্য, যা শুধু শুনলে মনে হয় না এটি রাজনৈতিক ভাষণ।” এটি আমাদের গর্বের প্রতীক।
বিষয় | বিবরণ |
---|---|
তারিখ | ৭ মার্চ, ১৯৭১ |
স্থান | রেসকোর্স ময়দান (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান), ঢাকা |
সময়কাল | ১৮ মিনিট (২:৪৫ থেকে ৩:০৩) |
বক্তা | বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান |
মূল বার্তা | “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” |
জনসংখ্যা | প্রায় ১০-১৫ লাখ মানুষ উপস্থিত |
বিশ্ব স্বীকৃতি | ২০১৭ সালে ইউনেস্কোর “Memory of the World” তালিকায় |
আজ আমরা যে স্বাধীনভাবে শ্বাস নিচ্ছি, তার পেছনে রয়েছে ৩০ লাখ শহীদের জীবন আর অসংখ্য মানুষের ত্যাগ। “ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ” আমাদের সেই ত্যাগের কথা মনে করিয়ে দেয়। এটি আমাদের শেখায়, স্বাধীনতা কোনো দান নয়, এটি অর্জন করতে হয়।
আজকের তরুণদের জন্য এই দিনটি একটি জ্বলন্ত শিক্ষা। এটি তাদের দেখায় কীভাবে একজন নেতা একটি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তাদের মনে দেশপ্রেম জাগাতে পারে এবং তাদেরকে দেশের জন্য কাজ করতে উৎসাহিত করতে পারে।
মুজিবরের মূর্তি ভাঙলেই কি আন্দোলনকারীরা মুছে ফেলতে পারবে কোটি কোটি বাঙালির
বর্তমানে আমরা যখন বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই – অর্থনৈতিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক – তখন “Historic 7th March” আমাদের শক্তি যোগায়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, একতা আর সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা যেকোনো বাধা পেরোতে পারি।
“ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ” আমাদের জন্য একটি জীবন্ত ইতিহাস। এটি আমাদের গর্ব, আমাদের শক্তি, আমাদের পরিচয়। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ আজও আমাদের মনে স্বাধীনতার আলো জ্বালিয়ে রাখে। এই দিনটি আমাদের শেখায় যে, আমরা একটি সংগ্রামী জাতি, যারা কখনো হাল ছাড়ে না। তাই আসুন, প্রতি বছর এই দিনটিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে একসঙ্গে কাজ করি। জয় বাংলা!
মন্তব্য করুন