আলু: যুদ্ধ-দুর্ভিক্ষের সাথী থেকে বাঙালির প্রিয় খাবার

History of potatoes in Bengal war famine: বাংলাদেশের খাদ্যতালিকায় আলু একটি অপরিহার্য উপাদান। কিন্তু এই সাধারণ সবজিটি কীভাবে বাঙালির জীবনে এত গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিল, তা জানা অনেকেরই নেই। আসলে…

Avatar

 

History of potatoes in Bengal war famine: বাংলাদেশের খাদ্যতালিকায় আলু একটি অপরিহার্য উপাদান। কিন্তু এই সাধারণ সবজিটি কীভাবে বাঙালির জীবনে এত গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিল, তা জানা অনেকেরই নেই। আসলে আলুর ইতিহাস যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ এবং ঔপনিবেশিক শাসনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।আলু মূলত দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিয় অঞ্চলের আদিবাসীদের খাদ্য ছিল। ১৬শ শতকে স্পেনীয় বিজয়ীরা এটি ইউরোপে নিয়ে আসে। ধীরে ধীরে আলু ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৮শ শতকের শেষের দিকে ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে আলু চাষ শুরু করে।বাংলায় আলুর আগমন ঘটে ১৭৮০ সালের দিকে। তখন বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ চলছিল, যা ইতিহাসে “ছিয়াত্তরের মন্বন্তর” নামে পরিচিত। এই দুর্ভিক্ষে প্রায় ১ কোটি মানুষ মারা যায়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশরা বাংলায় আলু চাষের প্রচলন করে। কারণ আলু সহজে চাষ করা যায় এবং এতে প্রচুর পুষ্টিগুণ রয়েছে।প্রথমদিকে বাঙালিরা আলু খেতে অনীহা প্রকাশ করে। তারা এটিকে “ফিরিঙ্গি আলু” বলে অবজ্ঞা করত। কিন্তু ধীরে ধীরে আলু বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে স্থান করে নেয়। বিশেষ করে ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় আলু অনেক মানুষের জীবন বাঁচিয়েছিল। এই দুর্ভিক্ষে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ মারা যায়।
এক চামচ মধু: মৌমাছির অসীম পরিশ্রমের ফসল
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দেয়, তখন আলু একটি বিকল্প খাদ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সময় থেকেই বাঙালিরা আলুকে তাদের নিত্যদিনের খাবারের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। আলু দিয়ে বিভিন্ন ধরনের তরকারি, চপ, সিঙ্গারা, আলুর দম ইত্যাদি তৈরি করা শুরু হয়।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও আলু বাঙালিদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য ছিল। যুদ্ধের সময় যখন অন্যান্য খাবারের সরবরাহ কমে যায়, তখন আলু অনেক পরিবারকে অনাহারে থাকা থেকে রক্ষা করেছিল। এই সময় থেকেই আলু বাঙালির খাদ্যতালিকায় স্থায়ী আসন পেয়ে যায়।বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়।
দেশের মোট কৃষি জমির প্রায় ৪% জুড়ে আলু চাষ হয়। বাংলাদেশ এখন আলু রপ্তানিও করছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ৫০ হাজার টন আলু রপ্তানি করেছে, যার মূল্য প্রায় ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।আলু এখন শুধু খাদ্য নয়, বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাঙালি রান্নার অনেক জনপ্রিয় পদেই আলু ব্যবহৃত হয়। যেমন – আলু ভাজি, আলুর দম, আলু পোস্ত, আলু বোখারা, মাংসের সাথে আলু ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন উৎসবে আলু দিয়ে তৈরি নাস্তা যেমন সিঙ্গারা, আলুর চপ খুবই জনপ্রিয়।আলুর পুষ্টিগুণও উল্লেখযোগ্য।

১০০ গ্রাম আলুতে রয়েছে:

  • ক্যালরি: ৭৭
  • কার্বোহাইড্রেট: ১৭ গ্রাম
  • ফাইবার: ২.২ গ্রাম
  • প্রোটিন: ২ গ্রাম
  • ভিটামিন সি: ১৯.৭ মিলিগ্রাম
  • পটাশিয়াম: ৪২১ মিলিগ্রাম

এছাড়া আলুতে ভিটামিন বি৬, থায়ামিন, নিয়াসিন, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি পুষ্টি উপাদান রয়েছে।আলু চাষের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১০০টি উন্নত জাতের আলু চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে কার্ডিনাল, ডায়মন্ট, গ্রানোলা, মুলতা ইত্যাদি জাত বেশি জনপ্রিয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) নিয়মিত নতুন জাতের আলু উদ্ভাবন করছে।
টাকি: কলকাতার কাছে একটি মনোরম পর্যটন কেন্দ্র

তবে আলু চাষে কিছু সমস্যাও রয়েছে। যেমন – রোগবালাই, কীটপতঙ্গের আক্রমণ, সংরক্ষণের সমস্যা ইত্যাদি। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আলু উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে আলুর ফলন কমে যায়।সব মিলিয়ে, আলু এখন বাঙালির খাদ্যতালিকার একটি অপরিহার্য অংশ। যুদ্ধ-দুর্ভিক্ষের সময় যে আলু বাঙালির জীবন বাঁচিয়েছিল, সেই আলু এখন বাঙালির প্রিয় খাবার। আলুর এই যাত্রা শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতি ও ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
About Author
Avatar

আমাদের স্টাফ রিপোর্টারগণ সর্বদা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন যাতে আপনি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পেতে পারেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রতিশ্রুতি আমাদের ওয়েবসাইটকে একটি বিশ্বস্ত তথ্যের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।তারা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ে বিশ্বাসী, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন তৈরিতে সক্ষম