বাচ্চাদের শ্বাসকষ্ট দূর করতে ঘরোয়া উপায় – যা আপনার সন্তানকে দ্রুত সুস্থ করবে!

Home remedies for children's respiratory distress: শীতকালে বাচ্চাদের শ্বাসকষ্ট একটি সাধারণ সমস্যা। সাধারণত ঠান্ডা লাগা, ফ্লু বা ব্রংকাইটিসের কারণে এই সমস্যা দেখা দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘরোয়া চিকিৎসায় এই সমস্যা কেটে…

Debolina Roy

 

Home remedies for children’s respiratory distress: শীতকালে বাচ্চাদের শ্বাসকষ্ট একটি সাধারণ সমস্যা। সাধারণত ঠান্ডা লাগা, ফ্লু বা ব্রংকাইটিসের কারণে এই সমস্যা দেখা দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘরোয়া চিকিৎসায় এই সমস্যা কেটে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন হতে পারে।শ্বাসকষ্টের লক্ষণগুলি হল কাশি, নাক দিয়ে পানি পড়া, জ্বর, গলা ব্যথা, পেশীতে ব্যথা ইত্যাদি। প্রথমে শুকনো কাশি হয়, পরে সবুজ বা হলুদ কফ বের হতে থাকে। এটি শ্বাসনালী আরও বন্ধ করে দিতে পারে, যার ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ বাচ্চা (৭৬%) এক সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে যায়। ৯১.৮% বাচ্চা দুই সপ্তাহের মধ্যে পুরোপুরি সেরে ওঠে। মাত্র ৪% বাচ্চাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। ১২% বাচ্চার ফলো-আপ ভিজিট প্রয়োজন হয়, যার মধ্যে ১৬% বাচ্চাকে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়।বাচ্চাদের শ্বাসকষ্ট দূর করার জন্য নিম্নলিখিত ঘরোয়া উপায়গুলি অবলম্বন করা যেতে পারে:

১. তরল পদার্থ বেশি করে খাওয়ানো:

গরম লেবুর শরবত, সুপ, মধু মিশ্রিত গরম পানি ইত্যাদি খাওয়ালে গলার জ্বালাপোড়া কমে এবং কফ সহজে বের হয়। এছাড়া আপেল জুস, পানি, আইসক্রিম, দুধ, তরমুজ, শসা ইত্যাদিও খাওয়ানো যেতে পারে। দুধ খেলে কফ বাড়ে – এটা ভুল ধারণা।

২. উঁচু করে শোয়ানো:

বিশ্রাম নেওয়া খুবই জরুরি। তবে কংজেশনের কারণে শ্বাস নিতে ও ঘুমাতে অসুবিধা হতে পারে। বিছানার মাথার দিকে কয়েকটি বালিশ দিয়ে উঁচু করে দিলে শ্বাস নিতে ও ঘুমাতে সুবিধা হবে।
চোখে আঘাত লাগলে তৎক্ষণাৎ করণীয়: একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

৩. বুকে গরম সেঁক দেওয়া:

কাশির ব্যথা কমাতে বুকে গরম কম্প্রেস দেওয়া যেতে পারে।

৪. আর্দ্রতা বাড়ানো:

গরম পানির বাষ্প নিলে শ্বাসপ্রশ্বাস সহজ হয়। রাতে ঘরে কুল মিস্ট হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করা যেতে পারে।

৫. ধোঁয়া এড়িয়ে চলা:

ধূমপান করা উচিত নয়। ধোঁয়া ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুসকে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং সুস্থ হতে বাধা দেয়।

৬. ওষুধ সাবধানে দেওয়া:

জ্বর বা ব্যথা কমাতে ৬ মাসের বেশি বয়সী বাচ্চাদের প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন দেওয়া যেতে পারে। তবে ৬ মাসের কম বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

৭. নাক পরিষ্কার করা:

নাকে স্যালাইন ড্রপস দিয়ে বাল্ব সিরিঞ্জ দিয়ে মিউকাস বের করে দিতে হবে। তবে অতিরিক্ত সাকশন করলে নাকে জ্বালা করতে পারে। কখনও কখনও শুধু স্যালাইন দিলেই হাঁচি এসে মিউকাস বের হয়ে যায়।

৮. স্টিম নেওয়া:

কুল মিস্ট হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করা যেতে পারে। গরম পানির বাথ দেওয়া যেতে পারে। জলীয় বাষ্প কংজেশন কমায়। তবে গরম বাষ্প পোড়া লাগার ঝুঁকি থাকে, তাই কুল মিস্ট হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করা ভালো।

৯. মধু খাওয়ানো:

১ বছরের বেশি বয়সী বাচ্চাদের মধু খাওয়ালে কাশি কমে। মধু ওভার-দ্য-কাউন্টার কাশির ওষুধের মতোই কাজ করে, তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই।

১০. হলুদ খাওয়ানো:

হলুদের অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও প্রদাহরোধী গুণ রয়েছে। এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কার্যকলাপ বাড়ায়, যা জ্বালাপোড়া কমাতে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। তাজা হলুদ সালাদে দেওয়া যেতে পারে বা আচার তৈরি করা যেতে পারে। অথবা ১/২ চা চামচ হলুদ গুঁড়োর সাথে ১ চা চামচ মধু মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে।

১১. লবণ পানি গার্গল:

লবণ পানি গার্গল করলে কফ ভেঙে যায় এবং গলার ব্যথা কমে। ১ গ্লাস গরম পানিতে ১ চা চামচ লবণ মিশিয়ে গার্গল করতে হবে। গিলে ফেলা যাবে না।

১২. আনারস খাওয়ানো:

আনারসের রসে ব্রোমেলিন থাকে, যার প্রদাহরোধী গুণ রয়েছে। এটি ব্রংকাইটিস ও অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট কফ ভাঙতে ও বের করতে সাহায্য করে।

১৩. থাইম ব্যবহার:

থাইমের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিস্প্যাজমোডিক গুণ রয়েছে। এটি শ্বাসনালী প্রসারিত করে এবং কফ বের করতে সাহায্য করে। থাইম ও আইভি লিফের নির্যাস সম্বলিত প্রস্তুতি ব্যবহার করে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৭% রোগীর কাশির লক্ষণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে এবং ৯০% রোগীর জীবনমান উন্নত হয়েছে।
সুস্থ সকালের শুরু: দিনের প্রথম ৪টি সেরা পানীয়

১৪. আদা খাওয়ানো:

আদার প্রদাহরোধী ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণ রয়েছে। এটি কাশি ও গলা ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। আদা চা বা আদা মিশ্রিত গরম পানি খাওয়ানো যেতে পারে।

১৫. রসুন খাওয়ানো:

রসুনের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিভাইরাল গুণ রয়েছে। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। রসুন সুপ বা রসুন মিশ্রিত খাবার খাওয়ানো যেতে পারে।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপরোক্ত ঘরোয়া উপায়গুলি অবলম্বন করে বাচ্চাদের শ্বাসকষ্ট দূর করা যায়।

তবে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে:

  • ১ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ১০০ ডিগ্রির বেশি জ্বর থাকলে
  • বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে
  • ৪ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাশি বা হুইজিং থাকলে
  • কফের সাথে রক্ত বের হলে
  • দুর্বলতা না কমলে
  • অ্যাজমা থাকা অবস্থায় ব্রংকাইটিস হলে

মনে রাখতে হবে, ৩ মাসের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের শ্বাসকষ্টই গুরুতর হতে পারে। তাই এক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।বাচ্চাদের শ্বাসকষ্ট দূর করতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হয় না। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি ভাইরাসজনিত। অ্যান্টিবায়োটিক শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের ক্ষেত্রে কাজ করে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া উচিত নয়।

বাচ্চাদের শ্বাসকষ্ট প্রতিরোধে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:

  • নিয়মিত হাত ধোয়া
  • ঠান্ডা লাগা এড়িয়ে চলা
  • পুষ্টিকর খাবার খাওয়া
  • ধূমপান এড়িয়ে চলা
  • নিয়মিত ব্যায়াম করা
  • পর্যাপ্ত ঘুম নেওয়া
  • টিকা দেওয়া

শ্বাসকষ্টের সময় বাচ্চাদের যত্ন নেওয়ার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক:

১. ধৈর্য ধরুন: সুস্থ হতে সময় লাগবে। বাচ্চাকে আরাম করতে দিন।
২. পর্যবেক্ষণ করুন: লক্ষণগুলি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করুন। কোনো উন্নতি না হলে বা অবস্থা খারাপ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৩. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন: বাচ্চার আশপাশ পরিষ্কার রাখুন। ঘরের বাতাস পরিষ্কার রাখুন।
৪. মানসিক সহায়তা দিন: বাচ্চাকে আশ্বস্ত করুন। তার পছন্দের গল্প শোনান বা কার্টুন দেখান।
৫. ওষুধ সঠিকভাবে দিন: চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ওষুধ দিন। নির্ধারিত মাত্রা ও সময় মেনে চলুন।শ্বাসকষ্টের সময় বাচ্চাদের খাবারের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। সহজপাচ্য খাবার দিন। গরম সুপ, ফলের রস, দই ইত্যাদি খাওয়াতে পারেন। খাবারের পরিমাণ কম কিন্তু বারবার দিন।মনে রাখবেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শ্বাসকষ্ট নিজে থেকেই সেরে যায়।
তবে যত্ন ও সঠিক পরিচর্যা দিলে দ্রুত সুস্থ হওয়া যায়। আপনার বাচ্চার অবস্থা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।শেষ কথা হল, বাচ্চাদের শ্বাসকষ্ট একটি সাধারণ সমস্যা। সঠিক যত্ন ও পরিচর্যায় এটি দ্রুত সেরে যায়। ঘরোয়া উপায়গুলি অবলম্বন করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যায়। তবে কোনো জটিলতা দেখা দিলে বা অবস্থা না কাটলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আপনার সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়।
About Author
Debolina Roy

দেবলীনা রায় একজন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক, যিনি স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে পাঠকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত। ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করা দেবলীনা তার লেখায় চিকিৎসা বিষয়ক জটিল তথ্যগুলি সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেন, যা সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য এবং উপকারী। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, এবং রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান এবং প্রাঞ্জল লেখনী পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দেবলীনা রায়ের লক্ষ্য হল সঠিক ও তথ্যনির্ভর স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করা এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।