হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখতে এড়িয়ে চলুন এই খাবারগুলি: একটি পুষ্টি নির্দেশিকা

Diet tips hormonal imbalance: আমাদের শরীরের সুস্থতা ও সুস্বাস্থ্যের জন্য হরমোন ভারসাম্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস এই নাজুক ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিছু নির্দিষ্ট খাবার…

Debolina Roy

 

Diet tips hormonal imbalance: আমাদের শরীরের সুস্থতা ও সুস্বাস্থ্যের জন্য হরমোন ভারসাম্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস এই নাজুক ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিছু নির্দিষ্ট খাবার হরমোন ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে এবং এগুলি এড়িয়ে চলা উচিত।

  1. প্রথমেই উল্লেখ করা যায় লাল মাংসের কথা। লাল মাংসে উচ্চ মাত্রায় সংতৃপ্ত চর্বি থাকে, যা শরীরে অতিরিক্ত এস্ট্রোজেন উৎপাদন করতে পারে। এটি হরমোন ভারসাম্য বিঘ্নিত করে এবং নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রজনন স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। লাল মাংসের পরিবর্তে সামুদ্রিক মাছ, ডিম বা শাকসবজি খাওয়া যেতে পারে।
  2. দ্বিতীয়ত, প্রক্রিয়াজাত খাবার থেকে দূরে থাকা উচিত। এই ধরনের খাবারে প্রচুর পরিমাণে চিনি, লবণ ও সংরক্ষক থাকে যা হরমোন ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। বিশেষ করে অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বাড়াতে পারে। এর ফলে ওজন বৃদ্ধি ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে।
  3. তৃতীয়ত, ক্যাফেইন সেবন সীমিত করা উচিত। অতিরিক্ত কফি বা চা পান করলে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা শরীরকে চাপের মধ্যে রাখে। এছাড়া ঘুমের প্যাটার্ন নষ্ট হয়ে মেলাটোনিন হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে। দিনে ১-২ কাপের বেশি কফি পান করা উচিত নয়।
    Kidney: গরমকালে কিভাবে সুস্থ রাখবেন কিডনি? [বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ]
  4. চতুর্থত, সয়া জাতীয় খাবার সীমিত করা প্রয়োজন। সয়াতে ফাইটোএস্ট্রোজেন নামক একটি উপাদান থাকে যা শরীরে এস্ট্রোজেনের মতো আচরণ করে। অতিরিক্ত সয়া সেবনে হরমোন ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (পিসিওএস) আক্রান্ত নারীদের সয়া খাবার সীমিত করা উচিত।
  5. পঞ্চমত, ডেয়রি জাতীয় খাবার কম খাওয়া ভালো। দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারে প্রচুর পরিমাণে হরমোন থাকে যা শরীরের স্বাভাবিক হরমোন উৎপাদনকে প্রভাবিত করতে পারে। এছাড়া অনেকের ক্ষেত্রে ল্যাক্টোজ ইনটলারেন্স দেখা যায় যা পাচনতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করে। ডেয়রি খাবারের পরিবর্তে বাদাম দুধ বা নারকেল দুধ খাওয়া যেতে পারে।
  6. ষষ্ঠত, রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট এড়িয়ে চলা উচিত। সাদা ময়দা, পাস্তা, কেক, বিস্কুট ইত্যাদি খাবার দ্রুত রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এতে ইনসুলিন হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। এর পরিবর্তে সাবুদানা, ওটস, ব্রাউন রাইস ইত্যাদি পূর্ণ শস্যদানা খাওয়া উচিত।
  7. সপ্তমত, কৃত্রিম মিষ্টিকারক থেকে দূরে থাকা প্রয়োজন। অ্যাসপার্টেম, সুক্রালোজ ইত্যাদি কৃত্রিম মিষ্টিকারক ইনসুলিন ও লেপটিন হরমোনের কার্যকারিতা নষ্ট করতে পারে। এর ফলে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত হয় এবং ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ে। এর পরিবর্তে প্রাকৃতিক মিষ্টিকারক যেমন স্টেভিয়া ব্যবহার করা যেতে পারে।
  8. অষ্টমত, অ্যালকোহল সেবন কমানো উচিত। অতিরিক্ত মদ্যপান লিভারের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং হরমোন মেটাবলিজমকে ব্যাহত করে। এছাড়া টেস্টোস্টেরন ও গ্রোথ হরমোনের মাত্রা কমে যায়। সপ্তাহে ১-২ পেগের বেশি মদ্যপান করা উচিত নয়।
  9. নবমত, ট্রান্স ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। ফাস্ট ফুড, চিপস, বিস্কুট ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ট্রান্স ফ্যাট থাকে যা শরীরে ইনফ্লামেশন বাড়ায় এবং হরমোন রিসেপ্টরগুলোর কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এর ফলে হরমোন ভারসাম্য নষ্ট হয়।
  10. দশমত, অতিরিক্ত লবণ সেবন কমানো উচিত। বেশি লবণ খেলে শরীরে সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির উপর চাপ পড়ে। এর ফলে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায় যা দীর্ঘমেয়াদে হরমোন ভারসাম্য নষ্ট করে।

এই খাবারগুলি এড়িয়ে চলার পাশাপাশি কিছু সুস্থ খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন যা হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। যেমন:

  • প্রচুর পরিমাণে তাজা ফল ও শাকসবজি খাওয়া। এগুলিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস হরমোন ভারসাম্য রক্ষা করে।
  • ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার যেমন সালমন, চিয়া সিড, আখরোট ইত্যাদি খাওয়া। এগুলি ইনফ্লামেশন কমায় ও হরমোন উৎপাদনে সাহায্য করে।
  • প্রোবায়োটিক খাবার যেমন দই, কেফির ইত্যাদি খাওয়া। এগুলি অন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা করে যা হরমোন মেটাবলিজমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা। এটি বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে সাহায্য করে ও হরমোন নিঃসরণে সহায়তা করে।
  • নিয়মিত ব্যায়াম করা। এটি ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায় ও স্ট্রেস হরমোন কমায়।
  • পর্যাপ্ত ঘুম নেওয়া। ভালো ঘুম মেলাটোনিন ও গ্রোথ হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হরমোন ভারসাম্য রক্ষার জন্য সামগ্রিক জীবনযাত্রার পরিবর্তন প্রয়োজন। শুধুমাত্র খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করলেই হবে না, সেই সাথে মানসিক চাপ কমানো, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম করাও জরুরি।

লিচুতে লুকিয়ে আছে অমৃত! জানুন ১০টি চমকপ্রদ স্বাস্থ্য উপকার যা আপনার জীবন বদলে দেবে!

তবে কোনো গুরুতর হরমোন সমস্যা থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০% মানুষ হরমোন সমস্যায় ভুগছেন। বিশেষ করে নারীদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। তাই খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।তবে মনে রাখতে হবে, প্রত্যেকের শরীর আলাদা এবং হরমোন ভারসাম্যের উপর বিভিন্ন খাবারের প্রভাব আলাদা হতে পারে। তাই নিজের শরীরের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে খাদ্যাভ্যাস ঠিক করা উচিত।

About Author
Debolina Roy

দেবলীনা রায় একজন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক, যিনি স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে পাঠকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত। ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করা দেবলীনা তার লেখায় চিকিৎসা বিষয়ক জটিল তথ্যগুলি সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেন, যা সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য এবং উপকারী। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, এবং রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান এবং প্রাঞ্জল লেখনী পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দেবলীনা রায়ের লক্ষ্য হল সঠিক ও তথ্যনির্ভর স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করা এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।