ভারতে শিশুদের পুষ্টিহীনতার চিত্র আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পোষণ ট্র্যাকার থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৭.৭৫% শিশু খর্বাকৃতির (স্টান্টিং) শিকার। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এই পরিসংখ্যানে আরও উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে যে, ১৭.১৯% শিশু কম ওজনের সমস্যায় ভুগছে। মহিলা ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক রাজ্যসভায় এক লিখিত উত্তরে এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
পোষণ ট্র্যাকারের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে ৮.৮০ কোটি শিশু (০-৬ বছর বয়সী) আঙ্গনওয়াড়িতে নথিভুক্ত রয়েছে, যার মধ্যে ৮.৫২ কোটি শিশুর উচ্চতা ও ওজন মাপা হয়েছে। এই পরিমাপের ভিত্তিতেই খর্বাকৃতির হার নির্ধারণ করা হয়েছে। মহিলা ও শিশুকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী সাবিত্রী ঠাকুর জানিয়েছেন যে, ৫ বছর পর্যন্ত বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এই হার আরও বেশি – ৩৯.০৯%।
আশঙ্কার বিষয় হলো, এই পরিসংখ্যান দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতির একটি গুরুতর সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৫ (২০১৯-২১) অনুযায়ী, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে স্টান্টিং-এর হার ছিল ৩৫.৫%। তুলনামূলকভাবে বর্তমান পরিস্থিতি আরও খারাপ বলে মনে হচ্ছে।
সিলেটের সেরা ১০ জন শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার: আপনার শিশুর স্বাস্থ্যসেবার জন্য নির্ভরযোগ্য গাইড
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিশুদের দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টির প্রকাশই হল স্টান্টিং। এর ফলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। সাধারণত জন্মের পর থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত সময়কালে পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাবে এই সমস্যা দেখা দেয়।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ০-৬ বছর বয়সী শিশুদের আনুমানিক জনসংখ্যা ১৬.১ কোটি। এর মধ্যে মাত্র ৮.৮ কোটি শিশু আঙ্গনওয়াড়ি সেবার আওতায় এসেছে। বাকি প্রায় ৭ কোটি শিশু এখনও এই গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি কর্মসূচির বাইরে রয়ে গেছে।
মন্ত্রকের দাবি অনুযায়ী, জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার তুলনায় পোষণ ট্র্যাকার বেশি নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রদান করে। কারণ এই ব্যবস্থা প্রতি মাসে প্রায় ৮.৫ কোটি শিশুর পুষ্টি অবস্থা পরিমাপ করে রিয়েল টাইম তথ্য প্রদান করে। অন্যদিকে NFHS প্রতি ৫-৬ বছর অন্তর মাত্র ৬.১ লাখ পরিবারের নমুনা নিয়ে সমীক্ষা পরিচালনা করে।
ভারতে শিশুদের অপুষ্টি একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক ২০২৪ অনুযায়ী, ভারতের অবস্থান ১২৭টি দেশের মধ্যে ১০৫তম। দেশে প্রায় ১৩.৭% মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে এবং ৩৫.৫% শিশু বয়সের তুলনায় খর্বাকৃতি হয়ে রয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, দলিত ও জনজাতি শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার উচ্চবর্ণের শিশুদের তুলনায় ৫০% বেশি। এটি দেশের সামাজিক বৈষম্যের একটি গুরুতর দিক তুলে ধরে। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্যগুলিতে শিশুদের অপুষ্টির হার জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক বেশি।
একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, ভারতে প্রায় ৭ কোটি শিশু ২৪ ঘণ্টা অভুক্ত থাকে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে অনাহারে থাকা শিশুর সংখ্যা ১৯.ৃ%, যা বাংলাদেশের ৫.৬% ও পাকিস্তানের ৯.২%-এর তুলনায় অনেক বেশি।
শিশুদের অপুষ্টি দূর করতে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি চালু করেছে। প্রধানমন্ত্রী মাতৃ বন্দনা যোজনা, মধ্যাহ্ন ভোজন কর্মসূচি এবং সমন্বিত শিশু উন্নয়ন সেবা (ICDS) এর মাধ্যমে পুষ্টি সেবা প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু এতসব প্রচেষ্টার পরও শিশুদের অপুষ্টির হার উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু খাদ্য সরবরাহ করলেই অপুষ্টি দূর হবে না। পরিচ্ছন্ন পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, মায়েদের শিক্ষা ও সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন করতে হবে। জন্মের পর প্রথম ১০০০ দিন শিশুর পুষ্টির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যে সময়ে বিশেষ যত্ন নিতে হয়।
আর্থিক ক্ষতির দিক থেকেও অপুষ্টি একটি বড় সমস্যা। বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী, ভারতে অপুষ্টির কারণে প্রতিবছর কমপক্ষে ৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুরা পরবর্তীতে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDG) অর্জনের জন্য ভারতকে ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুদের খর্বাকৃতির হার ৪০% কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে এই লক্ষ্য অর্জন অত্যন্ত কঠিন হবে। সরকারের পাশাপাশি সমাজের সকল স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি ও সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
আশার কথা হলো, কিছু রাজ্য অপুষ্টি কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। কেরালা, তামিলনাড়ু ও পাঞ্জাবের মতো রাজ্যে শিশুদের পুষ্টি পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভালো। এইসব রাজ্যের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সারাদেশে কার্যকর কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে।ভারতে শিশুদের খর্বাকৃতির সমস্যা শুধু একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি তথ্যে প্রকাশিত এই ভয়াবহ পরিসংখ্যান দেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি জরুরি সতর্কবার্তা।