হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক। তিনি শুধু সাহিত্যেই নয়, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন নাটকের মাধ্যমেও দর্শকদের মন জয় করেছিলেন। কিন্তু তাঁর নিজের জীবনে প্রথম রঙিন টেলিভিশন সেট কেনার ঘটনাটি বেশ মজার এবং তাৎপর্যপূর্ণ।
১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশে রঙিন টেলিভিশন সেট ছিল বিলাসিতার সামগ্রী। সে সময় হুমায়ূন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি তখন ইতিমধ্যেই জনপ্রিয় লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। কিন্তু একজন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতনে রঙিন টিভি কেনা ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার।
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে। এরপর থেকে তিনি ক্রমাগত লেখালেখি করে যাচ্ছিলেন। তাঁর বই পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। কিন্তু সে সময় বাংলাদেশে লেখকদের রয়্যালটি বা পারিশ্রমিক খুব কম ছিল। তাই শুধু লেখালেখি করে বড় অঙ্কের অর্থ উপার্জন করা সম্ভব ছিল না।
না ফেরার দেশে জনপ্রিয় বাংলা ব্যান্ড শিল্পী! ‘ফিরিয়ে দাও’ শোনা যাবে না আর
১৯৮৫ সালের দিকে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর প্রথম টেলিভিশন নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ লেখেন। এই নাটকটি দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এরপর তিনি পর পর কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক লেখেন, যেমন ‘বহুব্রীহি’, ‘আয়মায়’, ‘কোথাও কেউ নেই’ ইত্যাদি। এসব নাটকের মাধ্যমে তিনি অনেক বেশি পারিশ্রমিক পেতে শুরু করেন।
১৯৮৮ সালের দিকে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর প্রথম রঙিন টেলিভিশন সেটটি কেনেন। সে সময় এটি ছিল জাপানি ব্র্যান্ড সনির একটি ২১ ইঞ্চি রঙিন টিভি। এর দাম ছিল প্রায় ৫০,০০০ টাকা, যা সে সময়ের হিসেবে বিশাল অঙ্কের টাকা। তিনি এই টাকাটা জোগাড় করেছিলেন তাঁর টেলিভিশন নাটকের পারিশ্রমিক থেকে।
হুমায়ূন আহমেদ নিজেই একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি যখন প্রথম রঙিন টিভি কিনলাম, তখন আমার বাসায় অনেক লোক দেখতে আসত। তারা শুধু টিভি দেখার জন্য নয়, রঙিন টিভিতে কী দেখায় সেটা দেখার জন্য আসত।” এটা থেকেই বোঝা যায় সে সময় রঙিন টিভি কত দুর্লভ ছিল।
এই রঙিন টিভি কেনার পর হুমায়ূন আহমেদের জীবনে অনেক পরিবর্তন আসে। তিনি টেলিভিশন নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকে আরও বেশি মনোযোগী হন। তিনি বুঝতে পারেন যে, দৃশ্যমাধ্যমের শক্তি কতটা প্রবল। এর ফলে তিনি পরবর্তীতে নিজেই চলচ্চিত্র পরিচালনা শুরু করেন।
হুমায়ূন আহমেদের এই প্রথম রঙিন টিভি কেনার ঘটনাটি শুধু একজন লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের একটি ঘটনা নয়। এটি সেই সময়ের বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থারও একটি চিত্র তুলে ধরে। একজন প্রতিভাবান লেখককে কীভাবে নিজের প্রতিভাকে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রয়োগ করে সফলতা অর্জন করতে হয়েছিল, তার একটি উদাহরণ এটি।
হুমায়ূন আহমেদের এই রঙিন টিভি কেনার ঘটনাটি আরও একটি দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এটি দেখায় যে, তিনি শুধু সাহিত্যের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি নতুন প্রযুক্তি ও মাধ্যমকে গ্রহণ করতে সদা প্রস্তুত ছিলেন। এই মনোভাব তাঁকে পরবর্তীতে একজন সফল চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে সাহায্য করেছিল।
বর্তমানে যখন প্রায় প্রতিটি বাড়িতে রঙিন টিভি রয়েছে, তখন হুমায়ূন আহমেদের প্রথম রঙিন টিভি কেনার এই ঘটনাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, কীভাবে গত কয়েক দশকে আমাদের সমাজ ও প্রযুক্তি পরিবর্তিত হয়েছে। একই সঙ্গে এটি আমাদের দেখায় যে, একজন সৃজনশীল ব্যক্তি কীভাবে নিজের প্রতিভাকে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রয়োগ করে সাফল্য অর্জন করতে পারেন।
হুমায়ূন আহমেদের জীবনে এই রঙিন টিভি কেনার ঘটনাটি তাঁর ক্যারিয়ারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এর পর থেকে তিনি আরও বেশি করে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের জগতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারেন যে, দৃশ্যমাধ্যমের মাধ্যমে তিনি আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারবেন। ফলে তিনি তাঁর লেখার শৈলীকেও এমনভাবে পরিবর্তন করেন যাতে সেগুলো সহজেই চলচ্চিত্রে রূপান্তর করা যায়।
হুমায়ূন আহমেদের এই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিখতে পারি যে, নতুন প্রযুক্তি ও মাধ্যমকে কীভাবে নিজের সৃজনশীলতার সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়। তিনি দেখিয়েছেন যে, একজন লেখক শুধু বই লিখেই থেমে থাকতে পারেন না। বরং, তিনি বিভিন্ন মাধ্যমকে ব্যবহার করে নিজের ভাবনা ও চিন্তাকে আরও বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে দিতে পারেন।
বর্তমান সময়ে যখন ডিজিটাল মাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া এত প্রভাবশালী, তখন হুমায়ূন আহমেদের এই অভিজ্ঞতা থেকে আজকের লেখক ও শিল্পীরা অনেক কিছু শিখতে পারেন। তাঁরা বুঝতে পারেন যে, নতুন প্রযুক্তি ও মাধ্যমকে কীভাবে নিজের সৃজনশীলতার সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়।
শেষ পর্যন্ত, হুমায়ূন আহমেদের প্রথম রঙিন টিভি কেনার এই ঘটনাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, জীবনে সফলতা অর্জন করতে হলে নিজের প্রতিভাকে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হয়। একই সঙ্গে, নতুন প্রযুক্তি ও মাধ্যমকে গ্রহণ করার মানসিকতা থাকতে হয়। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর জীবনে এই দুটি জিনিসই করেছিলেন, যা তাঁকে একজন সফল লেখক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।