mobile radiation while sleeping: আমাদের দৈনন্দিন জীবনে স্মার্টফোন এখন অবিচ্ছেদ্য অংশ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই ছোট্ট যন্ত্রটি আমাদের সাথে থাকে। কিন্তু রাতে ঘুমানোর সময় ঘুমানোর সময় স্মার্টফোন কতটা দূরে রাখা উচিত – এই প্রশ্নটি অনেকেরই মনে জাগে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বালিশের নিচে বা পাশে ফোন রেখে ঘুমানো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি ডেকে আনতে পারে। আজকের এই লেখায় আমরা বিস্তারিতভাবে জানব যে কেন এবং কীভাবে আপনার স্মার্টফোনকে নিরাপদ দূরত্বে রাখবেন, যাতে আপনার ঘুম হয় গভীর এবং স্বাস্থ্য থাকে সুরক্ষিত।
স্মার্টফোনের ক্ষতিকর প্রভাব কী কী?
নীল আলোর মারাত্মক প্রভাব
স্মার্টফোনের স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলো আমাদের শরীরের জন্য একটি বড় সমস্যা। এই আলো আমাদের মেলাটোনিন হরমোনের উৎপাদনে বাধা দেয়। মেলাটোনিন হলো সেই হরমোন যা আমাদের ঘুমের চক্র নিয়ন্ত্রণ করে। যখন এই হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়, তখন ঘুম আসতে দেরি হয়, ঘুমের মান খারাপ হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে অনিদ্রার সমস্যা দেখা দেয়।
রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি রেডিয়েশনের ঝুঁকি
স্মার্টফোন থেকে ক্রমাগত রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি (RF) রেডিয়েশন নির্গত হয়। দীর্ঘ সময় ধরে এই রেডিয়েশনের সংস্পর্শে থাকলে মস্তিষ্ক এবং শরীরের হরমোন ব্যবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা এবং গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাব থাকতে পারে।
ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো নোটিফিকেশন
রাতভর ফোনে আসা বিভিন্ন নোটিফিকেশন, মেসেজ অ্যালার্ট এবং কলের শব্দ আমাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়। এর ফলে গভীর ঘুম হয় না এবং পরদিন ক্লান্তি ও মানসিক অবসাদ অনুভব হয়।
ঘুমানোর সময় স্মার্টফোন কত দূরে রাখবেন?
বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ
বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞরা সুপারিশ করেন যে ঘুমানোর সময় স্মার্টফোন কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ ফুট (প্রায় ১ মিটার) দূরে রাখা উচিত। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ আরও বেশি সতর্কতার জন্য ৬ ফুট বা তার বেশি দূরত্বের কথা বলেছেন।
আন্তর্জাতিক নির্দেশিকা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর জন্য ঘুমানোর সময় স্মার্টফোন এবং শরীরের মধ্যে অন্তত ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দেয়। আমেরিকার ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশন (FCC) সর্বনিম্ন ২০ সেন্টিমিটার (প্রায় ৮ ইঞ্চি) দূরত্বের কথা বলেছে।
গবেষণার ফলাফল
জাপানি গবেষকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় দেখা গেছে যে, শোয়া অবস্থায় স্মার্টফোন ব্যবহারের সময় দূরত্ব কম থাকলে ঘুমের মান উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপ হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে বসা অবস্থায় মানুষ ফোন ১৩.৩ থেকে ৩২.৯ সেন্টিমিটার দূরে রাখে, কিন্তু শোয়া অবস্থায় এই দূরত্ব কমে যায় ৯.৯ থেকে ২১.৩ সেন্টিমিটারে।
নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবহারিক উপায়
অ্যালার্মের জন্য বিকল্প সমাধান
অনেকে অ্যালার্মের জন্য ফোনটি বালিশের পাশে রাখেন। এর পরিবর্তে একটি পৃথক অ্যালার্ম ক্লক ব্যবহার করুন। যদি ফোনই ব্যবহার করতে হয়, তাহলে এটি রুমের অন্য প্রান্তে রাখুন যেন শব্দ শোনা যায় কিন্তু রেডিয়েশন পৌঁছাতে না পারে।
এয়ারপ্লেন মোড ব্যবহার করুন
ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফোনে এয়ারপ্লেন মোড চালু করুন বা ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রাখুন। এতে রেডিয়েশনের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায় এবং অহেতুক নোটিফিকেশনও আসে না।
Do Not Disturb মোড সক্রিয় করুন
রাতে ঘুমানোর আগে ফোনে Do Not Disturb মোড চালু করুন। এতে জরুরি কল ছাড়া অন্য কোনো নোটিফিকেশন আসবে না এবং আপনার ঘুমের ব্যাঘাত হবে না।
স্মার্টফোনের তাপ উৎপাদন ও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি
বালিশের নিচে ফোন রাখলে যথেষ্ট বায়ু চলাচল হয় না, ফলে ফোন অতিরিক্ত গরম হয়ে যেতে পারে। এর ফলে ব্যাটারি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি চরম ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিও থাকে। ফোন কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবহারকারী গাইডে এই বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে।
শোবার ঘরে ফোন রাখার সঠিক নিয়ম
বেডসাইড টেবিলে রাখুন
যদি ফোনটি শোবার ঘরেই রাখতে হয়, তাহলে বিছানা থেকে কমপক্ষে ১.৫ মিটার দূরে বেডসাইড টেবিলে রাখুন। এই দূরত্বে রাখলে রাতে ফোন হাতের কাছে পৌঁছানোর প্রলোভন কম হবে।
চার্জিং স্টেশন তৈরি করুন
ঘরের একটি নির্দিষ্ট কোণে চার্জিং স্টেশন তৈরি করুন যা বিছানা থেকে যথেষ্ট দূরে। রাতে ফোন সেখানে চার্জে দিয়ে রাখুন।
অন্য রুমে রাখার অভ্যাস করুন
সবচেয়ে ভালো হয় যদি আপনি ফোনটি সম্পূর্ণভাবে শোবার ঘরের বাইরে রাখতে পারেন। লিভিং রুমে বা অন্য কোনো রুমে চার্জে দিয়ে রাখুন।
বিশেষ পরিস্থিতিতে করণীয়
ভ্রমণের সময়
ভ্রমণের সময় যদি ফোনটি অ্যালার্মের জন্য ব্যবহার করতে হয়, তাহলে এয়ারপ্লেন মোড চালু করে Do Not Disturb মোড সক্রিয় করুন এবং যতটা সম্ভব দূরে রাখুন।
জরুরি যোগাযোগের প্রয়োজনে
যদি রাতে জরুরি যোগাযোগের জন্য ফোন রাখতে হয়, তাহলে কমপক্ষে ৩ ফুট দূরে রাখুন এবং শুধুমাত্র নির্দিষ্ট নম্বরগুলোর জন্য রিং টোন সক্রিয় রাখুন।
শিশু ও কিশোরদের জন্য বিশেষ সতর্কতা
শিশু ও কিশোরদের মস্তিষ্ক এখনও বিকশিত হচ্ছে, তাই তারা বয়স্কদের তুলনায় রেডিয়েশনের প্রতি বেশি সংবেদনশীল। তাদের ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্কতা প্রয়োজন এবং স্মার্টফোন আরও দূরে রাখা উচিত।
EMF রেডিয়েশন প্রতিরোধী পণ্য
বাজারে বিভিন্ন EMF রেডিয়েশন প্রতিরোধী পণ্য পাওয়া যায় যা রেডিয়েশনের মাত্রা ৮০% পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। তবে এগুলো ব্যবহারের পাশাপাশি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
স্মার্টফোনের যুগে আমাদের জীবনযাত্রা অনেক সহজ হয়েছে, কিন্তু ঘুমানোর সময় স্মার্টফোন কতটা দূরে রাখা উচিত সে বিষয়ে সচেতনতা আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী কমপক্ষে ৩-৪ ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন, রাতে এয়ারপ্লেন মোড ব্যবহার করুন এবং সম্ভব হলে শোবার ঘরের বাইরে ফোন রাখুন। মনে রাখবেন, প্রযুক্তি আমাদের সেবা করার জন্য, আমাদের স্বাস্থ্য নষ্ট করার জন্য নয়। আজ থেকেই এই সহজ অভ্যাসগুলো চালু করুন এবং উপভোগ করুন গভীর, নিরবচ্ছিন্ন ঘুমের আনন্দ।