Portuguese influence on Indian dairy: ভারতীয় খাদ্যসংস্কৃতিতে ছানার ব্যবহার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আজ যে ছানা দিয়ে আমরা নানা রকম মিষ্টি তৈরি করি, তার শুরুটা কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজরা ভারতে এসে ছানা তৈরি ও ব্যবহারের কৌশল শেখায় ভারতীয়দের। এর আগে পর্যন্ত ছানা ছিল একটি পরিত্যাজ্য খাদ্যদ্রব্য।
ছানার ইতিহাস: প্রাচীন থেকে মধ্যযুগ
প্রাচীন ভারতে ছানা ছিল একটি অপরিচিত খাদ্যদ্রব্য। সংস্কৃত অভিধানে ছানার তিনটি নাম পাওয়া যায় – আমিক্ষা, কিলাট এবং দুগ্ধকর্চিকা। তখনকার দিনে দুধের সারাংশ ক্ষীর হল পবিত্র বলে মনে করা হত। কিন্তু ছানাকে দেখা হত দুধের বিকৃত ও নষ্ট অংশ হিসেবে, যা অপবিত্র বলে গণ্য করা হত।
৫০টি মেয়েদের মিষ্টি ডাক নাম: সেরা মিষ্টি ও ভালোবাসাপূর্ণ নামের তালিকা
ছানার প্রতি প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গি
বিষয় | বর্ণনা |
---|---|
ছানার প্রতি ধারণা | বিকৃত ও নষ্ট দুধের অংশ |
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ | অপবিত্র খাদ্য |
ব্যবহার | পরিত্যাজ্য দ্রব্য |
এই কারণে প্রাচীন ভারতে ছানা ছিল একটি নিষিদ্ধ খাদ্যবস্তু। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বা দেবপূজায় ছানা ব্যবহারের কোনো বিধান ছিল না।
পর্তুগিজদের আগমন ও ছানার প্রচলন
১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গামা কালিকট বন্দরে আসেন এবং ১৫০৩ সালে ভারত ত্যাগ করেন। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে পর্তুগিজদের প্রভাব বাড়তে থাকে ভারতীয় খাদ্যাভ্যাসে।
পর্তুগিজদের অবদান
পর্তুগিজরা শুধু ছানা নয়, আরও অনেক খাদ্যদ্রব্য ও ফলমূল নিয়ে আসে ভারতে:
- ছানা তৈরি ও ব্যবহারের কৌশল
- পনির ও চিজ তৈরির পদ্ধতি
- আলু ও কাঁচা লঙ্কার চাষ
- পেয়ারা, আনারস, কাজুবাদাম, চিনেবাদাম, আঙ্গুর ইত্যাদি ফলের আমদানি
- পেঁপে চাষের প্রচলন
ছানার ব্যবহার শুরু
পর্তুগিজদের কাছ থেকে ছানা তৈরির কৌশল শেখার পর, ভারতীয় বিশেষত বাঙালি ময়রারা ধীরে ধীরে এর ব্যবহার শুরু করে। প্রথমদিকে ছানা ও ছানার মিষ্টি একরকম পরিত্যাজ্যই ছিল ধর্মীয় কারণে। কিন্তু ক্রমে ক্রমে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
ছানার প্রস্তুত প্রণালী
ছানা তৈরির পদ্ধতি:
- সিরকার সঙ্গে সমপরিমাণ জল মেশানো
- দুধ ফোটানো
- ফুটন্ত দুধে সিরকা মেশানো
- দুধের ছানা ও জল আলাদা করা
- ছাকনিতে ঢেলে ৬-৭ ঘণ্টা রাখা
- জল ঝরিয়ে ছানা ঠাণ্ডা জায়গায় রাখা
ছানার ব্যবহারে নতুন যুগের সূচনা
ছানার ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকেই বাংলার মিষ্টি শিল্পে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। ছানা দিয়ে তৈরি হতে থাকে নানা রকমের মিষ্টি:
- সন্দেশ
- রসগোল্লা
- রসমালাই
- চমচম
- পান্তুয়া
এই সময় থেকেই বাঙালির হেঁসেলে আগমন ঘটে ছানার।
ছানার ব্যবহার নিয়ে মতভেদ
যদিও অনেকে মনে করেন যে বাংলায় পর্তুগিজদের আসার আগেই ছানার ব্যবহার ছিল। কারণ ষোড়শ শতকে রচিত বাংলার মঙ্গলকাব্যগুলিতে ছানার উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এর বিপক্ষে যুক্তি হল, ষোড়শ শতকের যে সময় থেকে মঙ্গলকাব্যগুলিতে ছানার উল্লেখ দেখা যেতে শুরু করেছে তার আগে থেকেই পর্তুগিজরা বাংলায় জমিয়ে বসে গেছে ও নদীপথে দূর দূর গ্রামে গিয়ে নিজেদের পণ্য বিক্রয় করে আসছে।
ছানার বিকাশ ও বর্তমান অবস্থা
ছানার ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলার মিষ্টি শিল্পে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। আজ ছানা ছাড়া বাঙালির মিষ্টি কল্পনাই করা যায় না।
ছানার বিভিন্ন রূপ
- সন্দেশ: ছানা ও চিনি দিয়ে তৈরি এই মিষ্টি বাঙালির অতি প্রিয়।
- রসগোল্লা: ছানার গোলাকে চিনির রসে ফুটিয়ে তৈরি এই মিষ্টি এখন শুধু বাংলা নয়, সারা ভারতে জনপ্রিয়।
- রসমালাই: রসগোল্লাকে দুধে ডুবিয়ে রাখা হয় এই মিষ্টিতে।
- চমচম: ছানা দিয়ে তৈরি আরেক ধরনের মিষ্টি।
ছানার ব্যবসায়িক গুরুত্ব
ছানার ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকেই বাংলার মিষ্টি শিল্প একটি বড় শিল্পে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে:
- পশ্চিমবঙ্গের মিষ্টান্ন ব্যবসার একটি বড় অংশ ছানাভিত্তিক মিষ্টির উপর নির্ভরশীল।
- হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে এই শিল্পে।
- বাংলার বাইরেও ছানার মিষ্টি এখন জনপ্রিয়।
চিনি ব্যবহারের অন্ধকার দিক: জেনে নিন কি কি ক্ষতি করছেন নিজের
ছানার সাংস্কৃতিক প্রভাব
ছানার ব্যবহার শুধু খাদ্যাভ্যাসকেই পরিবর্তন করেনি, এর প্রভাব পড়েছে বাঙালি সংস্কৃতিতেও:
- উৎসব-অনুষ্ঠানে ছানার মিষ্টির ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
- বিয়ে-বিবাহে তাৎক্ষণিক তৈরি রসগোল্লা পরিবেশনের রীতি চালু হয়েছে।
- মিষ্টি উপহার দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
পর্তুগিজদের কাছ থেকে ছানার ব্যবহার শেখার পর থেকে বাঙালি খাদ্যসংস্কৃতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। যা একসময় পরিত্যাজ্য ছিল, তা-ই আজ বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ছানার এই যাত্রা শুধু খাদ্যাভ্যাসকেই বদলায়নি, বরং সামগ্রিকভাবে বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতিকেও প্রভাবিত করেছে। এভাবেই একটি বিদেশি প্রভাব কালক্রমে দেশীয় সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে, যা সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।