আপনি কি জানেন, দুটি কিডনি ছাড়াই, শুধুমাত্র একটি কিডনি নিয়েও একজন মানুষ পুরোপুরি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে? হ্যাঁ, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং মানবদেহের আশ্চর্যজনক ক্ষমতার কারণে এটি একেবারেই সম্ভব। জন্মগতভাবে একটি কিডনি থাকা, কিডনি দান করা অথবা কোনো রোগের কারণে একটি কিডনি অপসারণ করার পরেও মানুষ দীর্ঘ, সক্রিয় জীবন কাটাতে পারে। বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ একটি কিডনি নিয়ে বেঁচে আছেন।
ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশন (National Kidney Foundation)-এর মতে, একজন সুস্থ মানুষের একটি কিডনিই দুটি কিডনির প্রায় ৭৫% কাজ করতে সক্ষম। সময়ের সাথে সাথে, এই একটি কিডনি আকারে কিছুটা বড় হয়ে যায় এবং এর কর্মক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়, যাকে ডাক্তারি ভাষায় ‘কম্পেনসেটরি হাইপারট্রফি’ (Compensatory Hypertrophy) বলা হয়। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, কিডনি দাতাদের আয়ু সাধারণ মানুষের মতোই এবং তাদের কিডনি ফেইলিওরের ঝুঁকিও খুব সামান্য বেশি।
এই নিবন্ধে, আমরা how long can you live with one kidney (একটা কিডনি দিয়ে কতদিন বাঁচা যায়) এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব। আমরা এর পেছনের বিজ্ঞান, দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব, জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বের প্রেক্ষাপটে এর বাস্তবতা তুলে ধরব।
প্রেক্ষাপট: কেন একজন মানুষের একটি কিডনি থাকতে পারে?
সাধারণত তিনটি প্রধান কারণে একজন ব্যক্তির একটি কিডনি থাকতে পারে:
১. রেনাল এজেনেসিস (Renal Agenesis): এটি একটি জন্মগত অবস্থা যেখানে একজন শিশু একটি কিডনি নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডায়াবেটিস অ্যান্ড ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড কিডনি ডিজিজেস (NIDDK) অনুসারে, প্রতি ১,০০০ শিশুর মধ্যে প্রায় ১ জন এই অবস্থা নিয়ে জন্মায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, এটি অন্য কোনো শারীরিক পরীক্ষার সময় ঘটনাক্রমে ধরা পড়ে, কারণ একটি কিডনি নিয়ে জন্মানো শিশুরা সম্পূর্ণ সুস্থ থাকে।
২. কিডনি দান (Kidney Donation): একজন সুস্থ ব্যক্তি তার দুটি কিডনির মধ্যে একটিকে দান করতে পারেন এমন কোনো রোগীকে যার দুটি কিডনিই বিকল হয়ে গেছে। এটি ‘লিভিং ডোনেশন’ নামে পরিচিত এবং বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার মানুষ প্রতি বছর এই মহান কাজটি করে থাকেন। কিডনি দাতারা কঠোর মেডিকেল পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত হন এবং অস্ত্রোপচারের পরেও তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন।
৩. নেফ্রেকটমি (Nephrectomy): ক্যান্সার, গুরুতর সংক্রমণ, কিডনিতে পাথর বা অন্য কোনো আঘাতের কারণে কিডনি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সেই কিডনিটি সরিয়ে ফেলতে হয়। এই প্রক্রিয়াটিকে নেফ্রেকটমি বলা হয়। এক্ষেত্রেও, অন্য কিডনিটি সুস্থ থাকলে রোগী দ্রুত আরোগ্য লাভ করে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।
আয়ু এবং জীবনযাত্রার মান: একটি কিডনি নিয়ে জীবন (How long can you live with one kidney and its impact)
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, একটা কিডনি দিয়ে মানুষ কতদিন বাঁচে? এর সহজ এবং সবচেয়ে alent উত্তর হল— একটি সুস্থ কিডনি নিয়ে একজন মানুষ প্রায় স্বাভাবিক আয়ু পেতে পারে।
একটি কিডনি থাকার কারণে আয়ু কমে যাওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। কিডনি দাতাদের উপর পরিচালিত বহু দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা দেখিয়েছে যে, তাদের জীবনকাল এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য সাধারণ জনসংখ্যার মতোই থাকে। উদাহরণস্বরূপ, জনস হপকিন্স মেডিসিন (Johns Hopkins Medicine)-এর বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে সঠিক যত্ন নিলে একটি কিডনিই সারাজীবন সুস্থভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
তবে, কিছু দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি সামান্য বাড়তে পারে, যার জন্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন জরুরি। এই ঝুঁকিগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension): একটি কিডনিকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয় বলে সময়ের সাথে সাথে রক্তচাপ কিছুটা বাড়ার সম্ভাবনা থাকে।
- প্রোটিনিউরিয়া (Proteinuria): প্রস্রাবের সাথে অতিরিক্ত প্রোটিন বেরিয়ে যাওয়াকে প্রোটিনিউরিয়া বলে। এটি কিডনির উপর অতিরিক্ত চাপের একটি লক্ষণ হতে পারে।
- গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেশন রেট (GFR) কমে যাওয়া: GFR হল কিডনির রক্ত পরিষ্কার করার হারের পরিমাপ। একটি কিডনি থাকলে GFR স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কম থাকতে পারে, তবে তা সাধারণত স্থিতিশীল থাকে এবং উদ্বেগের কারণ হয় না।
এই ঝুঁকিগুলো মোকাবিলার জন্য চিকিৎসকরা নিয়মিত রক্তচাপ এবং প্রস্রাব পরীক্ষার পরামর্শ দেন।
কিডনি রোগ এবং দানের বাস্তবতা
কিডনি রোগের প্রকোপ বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র তথ্যমতে, অসংক্রামক রোগ, বিশেষ করে ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগের অন্যতম প্রধান কারণ।
- কিডনি বিকল রোগীর সংখ্যা: প্রায় ২ কোটি মানুষ কোনো না কোনো ধরনের কিডনি রোগে আক্রান্ত। প্রতি বছর প্রায় ৪০,০০০ রোগীর কিডনি বিকল হয়। এদের চিকিৎসার জন্য ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়।
- কিডনি দান: মূলত জীবিত নিকটাত্মীয়দের মধ্য থেকেই কিডনি দান করা হয়। আইন অনুযায়ী, শুধুমাত্র আত্মীয়রাই কিডনি দান করতে পারেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, দারিদ্র্যের কারণে দেশের কিছু অঞ্চলে অবৈধভাবে কিডনি কেনাবেচার একটি চক্র গড়ে উঠেছে। আল জাজিরার একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলাকে ‘এক কিডনির গ্রাম’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে বহু মানুষ টাকার বিনিময়ে তাদের কিডনি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। এটি একটি গুরুতর সামাজিক এবং স্বাস্থ্য সমস্যা।
একটি কিডনি নিয়ে সুস্থ থাকার উপায়: বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
আপনি যদি একটি কিডনি নিয়ে জীবনযাপন করেন, তবে আপনার কিডনিটিকে সুস্থ রাখা আপনার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। কিডনি কেয়ার ইউকে (Kidney Care UK)-এর মতো সংস্থাগুলো নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উপর জোর দেয়:
১. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
- লবণ কম খান: অতিরিক্ত লবণ রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়, যা কিডনির জন্য ক্ষতিকর। প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্ট ফুড এবং প্যাকেজড স্ন্যাকস এড়িয়ে চলুন।
- পরিমিত প্রোটিন: অতিরিক্ত প্রোটিন কিডনির উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। আপনার চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে আপনার জন্য সঠিক প্রোটিনের পরিমাণ নির্ধারণ করুন।
- প্রচুর পানি পান করুন: পর্যাপ্ত পানি কিডনিকে শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ দূর করতে সাহায্য করে।
২. নিয়মিত ব্যায়াম
সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম, যেমন দ্রুত হাঁটা, সাঁতার বা সাইকেল চালানো, আপনার রক্তচাপ এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে।
৩. রক্তচাপ এবং ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ
নিয়মিত আপনার রক্তচাপ মাপুন এবং তা ১৪০/৯০ mmHg-এর নিচে রাখার চেষ্টা করুন। ডায়াবেটিস থাকলে ব্লাড সুগার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করুন।
৪. ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ
ধূমপান কিডনিতে রক্ত সরবরাহ কমিয়ে দেয় এবং এর কার্যক্ষমতা হ্রাস করে। মদ্যপানও রক্তচাপ বাড়িয়ে কিডনির ক্ষতি করতে পারে।
৫. ব্যথানাশক ঔষধের ব্যবহারে সতর্কতা
কিছু সাধারণ ব্যথানাশক ঔষধ, যেমন নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস (NSAIDs) (যেমন আইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোক্সেন), অতিরিক্ত বা দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারে কিডনির ক্ষতি করতে পারে। যেকোনো ঔষধ খাওয়ার আগে সর্বদা চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৬. নিয়মিত মেডিকেল চেক-আপ
বছরে অন্তত একবার চিকিৎসকের কাছে গিয়ে কিডনির কার্যকারিতা পরীক্ষা (রক্তে ক্রিয়েটিনিন এবং eGFR) এবং প্রস্রাব পরীক্ষা (ACR) করানো উচিত।
ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গি এবং উপসংহার
চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে, একটি কিডনি নিয়ে জীবনযাপন করা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ এবং স্বাভাবিক। একটি কিডনি সাধারণত দুটি কিডনির কাজ সফলভাবে চালিয়ে নিতে পারে এবং মানুষ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। মূল বিষয় হল সচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক যত্ন।
how long can you live with one kidney এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে মূলত ব্যক্তির জীবনযাত্রা, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উপর। সঠিক যত্ন এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস মেনে চললে, একটি কিডনি নিয়েও দীর্ঘ ও পরিপূর্ণ জীবন লাভ করা সম্ভব। এটি মানবদেহের অসাধারণ অভিযোজন ক্ষমতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ Section)
১. একটি কিডনি নিয়ে কি স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব?
উত্তর: হ্যাঁ, একেবারে সম্ভব। বেশিরভাগ মানুষ একটি কিডনি নিয়ে কোনো বড় ধরনের সমস্যা ছাড়াই সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং সক্রিয় জীবনযাপন করেন। তাদের আয়ুও সাধারণ মানুষের মতোই হয়।
২. একটি কিডনি থাকলে কি কি খাবার এড়িয়ে চলতে হবে?
উত্তর: কোনো বিশেষ খাবার পুরোপুরি বর্জন করার প্রয়োজন নেই, তবে একটি স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাদ্যতালিকা অনুসরণ করা জরুরি। অতিরিক্ত লবণ, প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং অতিরিক্ত প্রোটিন এড়িয়ে চলা উচিত। আপনার জন্য উপযুক্ত খাদ্যতালিকার জন্য একজন ডায়েটিশিয়ানের সাথে কথা বলতে পারেন।
৩. একটি কিডনি থাকলে কি খেলাধুলা করা যায়?
উত্তর: হ্যাঁ, নিয়মিত ব্যায়াম এবং খেলাধুলা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তবে, যে সব খেলাধুলায় কিডনিতে সরাসরি আঘাত লাগার ঝুঁকি থাকে (যেমন বক্সিং, ফুটবল, হকি, মার্শাল আর্ট), সেগুলো খেলার আগে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা ভালো। প্রয়োজনে কিডনি গার্ড ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪. কিডনি দাতাদের কি ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হয়?
উত্তর: কিডনি দাতাদের দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি খুবই কম। গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের কিডনি ফেইলিওর বা হৃদরোগের ঝুঁকি সাধারণ মানুষের তুলনায় খুব সামান্য বেশি। নিয়মিত মেডিকেল চেক-আপের মাধ্যমে এই ঝুঁকিগুলো সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
৫. গর্ভাবস্থায় একটি কিডনি থাকা কি ঝুঁকিপূর্ণ?
উত্তর: একটি কিডনি নিয়ে মহিলারা সফলভাবে গর্ভধারণ করতে পারেন। তবে, তাদের ক্ষেত্রে প্রি-এক্লাম্পসিয়া (গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ) হওয়ার ঝুঁকি কিছুটা বেশি থাকে। তাই, গর্ভাবস্থায় একজন নেফ্রোলজিস্ট এবং স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকা উচিত।