How many trees are there in the world?: পৃথিবীর চারপাশে তাকালেই দেখতে পাবেন সবুজ গাছের সমারোহ। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন পৃথিবীতে মোট কতটি গাছ রয়েছে? এই প্রশ্নটি আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও এর উত্তর আসলে বিজ্ঞানীদের কাছেও দীর্ঘদিন রহস্য ছিল। আজকের এই বিস্তৃত আলোচনায় আমরা জানব পৃথিবীর গাছের বিস্ময়কর সংখ্যা, তাদের বিতরণ এবং কেন এই তথ্যগুলো আমাদের ভবিষ্যতের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ।
বিজ্ঞানীরা কীভাবে গণনা করলেন পৃথিবীর গাছের সংখ্যা
২০১৫ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা ধারণা করতেন পৃথিবীতে মাত্র ৪০০ বিলিয়ন গাছ রয়েছে। কিন্তু ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নেতৃত্বে পরিচালিত এক যুগান্তকারী গবেষণা এই ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দেয়।
গবেষণাটি ছিল অত্যন্ত জটিল এবং পরিকল্পিত। বিজ্ঞানীরা স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করে অ্যান্টার্কটিকা বাদে পৃথিবীর সব মহাদেশের বনভূমিকে চার লাখ ভাগে ভাগ করেন। তারপর সেই এলাকাগুলোর আবহাওয়া, মানুষের কর্মকাণ্ড, মাটির অবস্থা এবং বন ঘনত্ব বিশ্লেষণ করে সুপার কম্পিউটারের সাহায্যে চূড়ান্ত গণনায় পৌঁছান।
বিশ্বের ৭টি সর্বাধিক পবিত্র গাছ: যেখানে আধ্যাত্মিকতা ও প্রকৃতির মিলন ঘটেছে
প্রাচীন পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা
আগের গবেষণাগুলো মূলত স্যাটেলাইট চিত্রের উপর নির্ভর করত, যা গাছের ঘনত্ব সঠিকভাবে পরিমাপ করতে পারত না। নতুন পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ এবং স্যাটেলাইট প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে অনেক বেশি নির্ভুল ফলাফল পাওয়া সম্ভব হয়েছে।
চমকপ্রদ আবিষ্কার: ৩.০৪ ট্রিলিয়ন গাছ!
নেচার জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণার ফলাফল সত্যিই অবিশ্বাস্য। পৃথিবীতে বর্তমানে ৩.০৪ ট্রিলিয়ন গাছ রয়েছে। এই সংখ্যাটি বাংলায় লিখলে দাঁড়ায় তিন লাখ চার হাজার কোটি!
এই বিপুল সংখ্যার মানে হলো পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য রয়েছে গড়ে ৪২২টি গাছ। শুনতে অনেক মনে হলেও আসল চিত্র কিন্তু ভিন্ন।
তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি
এই সংখ্যা আগের অনুমানের তুলনায় প্রায় সাড়ে সাতগুণ বেশি। কিন্তু ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটি আশঙ্কাজনক। কারণ প্রাচীনকালে পৃথিবীতে ছিল প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন গাছ – যা বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ।
বিশ্বব্যাপী গাছের বিতরণ: কোথায় কত গাছ?
পৃথিবীর গাছগুলো সমানভাবে বিতরণ করা নয়। ভৌগোলিক অবস্থান এবং জলবায়ুর উপর নির্ভর করে বিভিন্ন অঞ্চলে গাছের সংখ্যা ভিন্ন।
অঞ্চলভিত্তিক বিতরণ
- গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপগ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল: পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক গাছ (৪৬%) এই অঞ্চলে অবস্থিত
- নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল: ২০% গাছ এই এলাকায় পাওয়া যায়
- বোরিয়াল বন: উত্তর আমেরিকা, স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও রাশিয়ার সরু পাতার গাছের বন, যেখানে রয়েছে ৭৫০ বিলিয়ন গাছ – পৃথিবীর মোট গাছের ২৪%
গাছের ঘনত্বের রহস্য
আশ্চর্যজনকভাবে, গাছের সংখ্যা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বেশি হলেও গাছের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি চরম ঠান্ডা অঞ্চলে। মেরু প্রান্তে প্রতি বর্গমিটারে একটি করে গাছ রয়েছে।
দেশভিত্তিক গাছের পরিসংখ্যান
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গাছের সংখ্যা ও ঘনত্ব ভিন্ন। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হলো:
সর্বোচ্চ গাছের সংখ্যা
দেশগাছের সংখ্যা (আনুমানিক)রাশিয়া৬৪২ বিলিয়নকানাডা৩১৮ বিলিয়নব্রাজিলউল্লেখযোগ্য সংখ্যকযুক্তরাষ্ট্রউল্লেখযোগ্য সংখ্যকচীনউল্লেখযোগ্য সংখ্যক
সর্বোচ্চ বনাচ্ছাদন শতাংশ
তবে বনাচ্ছাদনের দিক থেকে এগিয়ে আছে কিছু ছোট দেশ:
- সুরিনাম: ৯৮.৩% বনাচ্ছাদন
- মাইক্রোনেশিয়া: ৯২% বনাচ্ছাদন
- গ্যাবন: ৯০% বনাচ্ছাদন
- পালাউ: ৮৮% বনাচ্ছাদন
- ফিনল্যান্ড: প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৭২,৬৪৪টি গাছ – সর্বোচ্চ ঘনত্ব
পৃথিবীতে এখনো ১৭টি দেশ স্বাধীন নয় – জানুন কোন কোন দেশগুলি এখনো উপনিবেশ!
বৃক্ষ প্রজাতির বৈচিত্র্য: আবিষ্কৃত ও অনাবিষ্কৃত
পৃথিবীতে গাছের সংখ্যার পাশাপাশি প্রজাতিগত বৈচিত্র্যও বিস্ময়কর। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী:
বর্তমান প্রজাতির সংখ্যা
- মোট প্রজাতি: প্রায় ৭৩,৩০০ বৃক্ষ প্রজাতি বিদ্যমান
- আবিষ্কৃত প্রজাতি: ৬৪,০০০ প্রজাতি ইতিমধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে
- অনাবিষ্কৃত প্রজাতি: প্রায় ৯,২০০ প্রজাতি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি
নতুন প্রজাতির আবিষ্কার ২০২৫ সালে
২০২৫ সালেও বিজ্ঞানীরা নতুন বৃক্ষ প্রজাতি আবিষ্কার করে চলেছেন। উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে:
- আসামে: গার্সিনিয়া কুসুমে (Garcinia kusumae) নামক নতুন ঔষধি গাছ
- তানজানিয়ায়: টেসম্যানিয়া প্রিন্সেপস (Tessmannia princeps) – ৩,০০০ বছরের পুরাতন গাছের প্রজাতি
- অরুণাচল প্রদেশে: বেগোনিয়া নিশিওরাম (Begonia nyishiorum) নামক নতুন ফুলের গাছ
বিপদাপন্ন অবস্থা: প্রতিবছর কত গাছ হারাচ্ছি?
দুঃখজনক সত্য হলো, পৃথিবীতে গাছের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক:
বার্ষিক গাছ নিধনের হার
- কর্তিত গাছ: প্রতিবছর প্রায় ১৫ বিলিয়ন গাছ কেটে ফেলা হয়
- রোপিত গাছ: বিপরীতে মাত্র ৫ বিলিয়ন গাছ নতুন করে রোপণ করা হয়
- নিট ক্ষতি: বছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন গাছ হারিয়ে যাচ্ছে
ঐতিহাসিক ক্ষতির পরিমাণ
গত ১২,০০০ বছরে মানব সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে আমরা হারিয়েছি অর্ধেক গাছ। কৃষিকাজ শুরু হওয়ার পর থেকে পৃথিবী তার ৫০% বনভূমি হারিয়ে ফেলেছে।
ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস: ২০৫০ সালে কী অবস্থা হবে?
সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের গবেষণা অনুযায়ী, বর্তমান নীতিমালা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্ব হারাবে এক মিলিয়ন বর্গমাইলের বেশি বনভূমি।
দুটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি
নেতিবাচক দৃশ্যপট:
- গাছের সংখ্যা কমে ২ ট্রিলিয়নে নেমে আসতে পারে
- অনেক ছোট ও মধ্যম আয়ের দেশে বনাচ্ছাদন ১%-এর নিচে নেমে যেতে পারে
ইতিবাচক সম্ভাবনা:
- সঠিক নীতিমালা প্রয়োগে গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে
- ২০২০ সালের পর বেশিরভাগ দেশে বন উজাড়ের হার কমেছে
- বিশ্বব্যাপী বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গৃহীত হচ্ছে
গাছ সংরক্ষণের গুরুত্ব ও আমাদের করণীয়
প্রতিটি গাছ আমাদের পরিবেশের জন্য অমূল্য সম্পদ। গাছের সংখ্যা জানার পর এখন প্রয়োজন সেগুলো রক্ষা করার।
গাছের অবদান
- কার্বন শোষণ: বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নিয়ে অক্সিজেন নিঃসরণ
- দূষণ নিয়ন্ত্রণ: শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই গাছগুলো বছরে ১৭.৪ মিলিয়ন টন দূষণকারী পদার্থ শোষণ করে
- জীববৈচিত্র্য রক্ষা: লাখো প্রাণীর আবাসস্থল
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ: বন্যা ও ভূমিধস রোধ
আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা
- বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ
- অপ্রয়োজনীয় কাগজের ব্যবহার কমানো
- পরিবেশবান্ধব নীতি সমর্থন করা
- নতুন প্রজন্মের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি
পৃথিবীতে মোট কতটি গাছ রয়েছে – এই প্রশ্নের উত্তর এখন আমাদের জানা। ৩.০৪ ট্রিলিয়ন গাছের এই বিশাল সংখ্যা একদিকে যেমন আশ্বস্ত করে, অন্যদিকে প্রাচীনকালের তুলনায় অর্ধেক গাছ হারানোর বাস্তবতা আমাদের সতর্ক করে। প্রতিদিন ৪১ মিলিয়ন গাছ কাটা হচ্ছে বলে আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই সবুজ সম্পদ রক্ষা করা সবার দায়িত্ব। আপনিও এই মহান কাজে অংশ নিন এবং অন্যদের উৎসাহিত করুন।