ভারত এখন ডিজিটাল বিপ্লবের একটি বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ভারতে একজন গড় মোবাইল ব্যবহারকারী প্রতি মাসে প্রায় ২৭.৫ গিগাবাইট (GB) ডেটা ব্যবহার করছেন। এই পরিসংখ্যান শুধুমাত্র ডেটা ব্যবহারের বিশালতাই নয়, বরং দেশের ডিজিটাল অগ্রগতি এবং সাশ্রয়ী ইন্টারনেট পরিষেবার প্রভাবকেও তুলে ধরে। এই পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে, যা ভারতকে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ডেটা খরচকারী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এই ডেটা ব্যবহারের পিছনে রয়েছে একটি বড় গল্প। ২০২৫ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন ১০০ কোটিরও বেশি। এর মধ্যে ৫জি প্রযুক্তির প্রসার ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে ৫জি ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে ২৭.১ কোটি ছাড়িয়েছে। এই পরিবর্তনের মূলে রয়েছে সাশ্রয়ী ডেটা প্ল্যান, স্মার্টফোনের ব্যাপক প্রাপ্যতা এবং ভিডিও কনটেন্টের জনপ্রিয়তা। প্রতিদিন গড়ে একজন ব্যবহারকারী প্রায় ১ গিগাবাইট ডেটা খরচ করছেন, যার বেশিরভাগই যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া, ভিডিও স্ট্রিমিং এবং অনলাইন গেমিংয়ে। ইনস্টাগ্রাম রিলস, ইউটিউব এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম এখন মানুষের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
বিষয়টির গভীরে গেলে দেখা যায়, শুধু মেট্রো শহর নয়, টিয়ার-২ এবং টিয়ার-৩ শহরগুলোতেও ডেটা ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এই অঞ্চলগুলোতে মাসিক ডেটা খরচ ৩৫ থেকে ৪০ গিগাবাইট পর্যন্ত পৌঁছেছে, যা বড় শহরগুলোর তুলনায় বেশি। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গ্রামীণ এবং আধা-শহরাঞ্চলে স্মার্টফোনের প্রবেশ এবং সস্তা ডেটা প্ল্যানের প্রাপ্যতা এই প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, জিও এবং এয়ারটেলের মতো টেলিকম সংস্থাগুলো মাত্র কয়েক টাকায় দৈনিক ১-২ গিগাবাইট ডেটা দিচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের কাছে ইন্টারনেটকে আরও সহজলভ্য করেছে। ফলে, শিক্ষা, বিনোদন এবং যোগাযোগের জন্য ইন্টারনেটের উপর নির্ভরতা বেড়েছে।
এই প্রসঙ্গে আরও কিছু তথ্য যোগ করলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়। স্পিডটেস্ট গ্লোবাল ইনডেক্সের মতো নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়, ভারতের মোবাইল ইন্টারনেটের গড় ডাউনলোড গতি এখন ৭৫.৮৬ এমবিপিএস, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। এই দ্রুত গতির ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের উচ্চমানের ভিডিও দেখতে এবং বড় ফাইল ডাউনলোড করতে উৎসাহিত করছে। তবে, শুধু বিনোদনই নয়, অনলাইন শিক্ষা এবং কাজের জন্যও ডেটা ব্যবহার বাড়ছে। মহামারীর পর থেকে অনলাইন ক্লাস এবং ওয়ার্ক ফ্রম হোমের প্রচলন বেড়েছে, যা ডেটা খরচের আরেকটি বড় কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতের প্রায় ৩১ শতাংশ মানুষ তাদের ফোন কখনো বন্ধ করেন না, যা ডেটা ব্যবহারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।
সহজ কথায় বলতে গেলে, ভারতের মানুষ এখন ইন্টারনেট ছাড়া জীবন কল্পনা করতে পারেন না। একটি শিশু যেমন কাঁদলে তাকে শান্ত করতে রিলস চালিয়ে দেওয়া হয়, তেমনই বড়রা বিরক্তি দূর করতে ভিডিও দেখেন। এই প্রবণতা শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং জীবনযাত্রার একটি অংশ হয়ে উঠেছে। তবে, এত বেশি ডেটা ব্যবহারের পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি আরও উদ্বেগজনক, কারণ গড়ে ৮৬ শতাংশ প্রি-স্কুল শিশু স্মার্টফোনে আসক্ত, যা তাদের বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ঘটনার সামগ্রিক চিত্র বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতি এই ডেটা ব্যবহারের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। সরকারের ডিজিটাল ইন্ডিয়া প্রকল্প এবং টেলিকম কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতা এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ভবিষ্যতে এই পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে। কিছু রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগামী ৫ বছরে ভারতের গড় মাসিক ডেটা ব্যবহার ৭৫ গিগাবাইট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এটি শুধু প্রযুক্তির উন্নতি নয়, বরং মানুষের জীবনধারার পরিবর্তনেরও একটি ইঙ্গিত।
সব মিলিয়ে, ভারতের মোবাইল ব্যবহারকারীদের ডেটা খরচের এই পরিসংখ্যান একটি নতুন যুগের সূচনা করছে। এটি দেশের অগ্রগতির পাশাপাশি কিছু চিন্তার বিষয়ও তুলে ধরছে। তবে, সাশ্রয়ী ইন্টারনেট এবং উন্নত প্রযুক্তির এই সমন্বয় ভারতকে বিশ্বের ডিজিটাল মানচিত্রে আরও শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে।