Skin transplant for Burn Victims: আগুনে পুড়ে যাওয়া একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা যা মানুষের জীবনকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে আগুনে পোড়া রোগীদের যেভাবে স্কিন প্রতিস্থাপন করা হয় সেই পদ্ধতি হয়ে উঠেছে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক অনন্য সাফল্য। যখন কোনো ব্যক্তি গুরুতর পোড়ার শিকার হন, তখন ত্বক প্রতিস্থাপন বা স্কিন গ্রাফটিং তাদের জীবন রক্ষার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়। এই জটিল কিন্তু অত্যাবশ্যক অস্ত্রোপচার পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা প্রতিটি মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
স্কিন গ্রাফটিং কী এবং কেন প্রয়োজন
স্কিন গ্রাফটিং হলো এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে শরীরের সুস্থ অংশ থেকে ত্বক সংগ্রহ করে পোড়া বা ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে প্রতিস্থাপন করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় সুস্থ ত্বকটি পরবর্তীতে হারিয়ে যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত ত্বককে ঢেকে রাখতে ব্যবহৃত হয়।
আগুনে পোড়া রোগীদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অত্যন্ত জরুরি কারণ:
- গুরুতর পোড়ায় ত্বকের গভীর স্তর নষ্ট হয়ে যায়
- প্রাকৃতিকভাবে নিরাময় সম্ভব হয় না
- সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে
- শরীরের তরল ও তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত হয়
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য নিষিদ্ধ খাবারের তালিকা: সুস্থ থাকার গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা
স্কিন গ্রাফটের প্রকারভেদ
স্প্লিট-থিকনেস স্কিন গ্রাফট (STSG)
এই পদ্ধতিতে ত্বকের উপরিভাগের একটি পাতলা স্তর সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত নিতম্ব, উরু বা বাছুরের মতো অংশ থেকে এই ত্বক নেওয়া হয় যেগুলো ভালোভাবে নিরাময় হতে পারে। এটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পদ্ধতি কারণ এর সফলতার হার বেশি।
ফুল-থিকনেস স্কিন গ্রাফট (FTSG)
ফুল-থিকনেস গ্রাফটে ত্বকের এপিডার্মিস এবং ডার্মিস উভয়েরই সম্পূর্ণ অংশ নেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে ত্বকের সম্পূর্ণ পুরুত্ব সরানো হয় এবং সেই স্থানটি সেলাই দিয়ে বন্ধ করা হয়। সাধারণ দাতা স্থানগুলি হলো:
- তলপেট
- অভ্যন্তরীণ বাহু ও উরু
- সুপারক্ল্যাভিকুলার এলাকা
- কুঁচকি ও চোখের পাতা
কম্পোজিট গ্রাফট
যখন কোনো দাতা স্থানে অন্তর্নিহিত পেশী বা হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। নাক বা কানের মতো অংশের জন্য তরুণাস্থিসহ গ্রাফট করা হয়।
আগুনে পোড়া রোগীদের স্কিন প্রতিস্থাপনের ধাপসমূহ
প্রাথমিক প্রস্তুতি ও মূল্যায়ন
চিকিৎসকরা প্রথমে পোড়ার গভীরতা ও ব্যাপ্তি নির্ধারণ করেন। তৃতীয় ডিগ্রি বা গভীর দ্বিতীয় ডিগ্রি পোড়ার ক্ষেত্রে স্কিন গ্রাফট অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে।
ক্ষত ত্বক অপসারণ
পুড়ে যাওয়া ও মৃত ত্বক প্রথমে অপসারণ করা হয়, যাতে সংক্রমণের ঝুঁকি কমে এবং প্রতিস্থাপনের জন্য পরিষ্কার ভিত্তি তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়াকে ডিব্রাইডমেন্ট বলা হয়। রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য চিকিৎসকরা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেন।
সুস্থ ত্বক সংগ্রহ
ডার্মাটোম নামক বিশেষ যন্ত্র দিয়ে রোগীর সুস্থ অংশ থেকে ত্বক সংগ্রহ করা হয়। এই যন্ত্রটি ত্বকের একটি নির্দিষ্ট পুরুত্বের স্তর কেটে নিতে পারে।
গ্রাফট প্রস্তুতকরণ
সংগৃহীত ত্বককে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রস্তুত করা হয়। বড় এলাকা ঢাকার জন্য স্কিন মেশার নামক যন্ত্র দিয়ে ত্বকে ছোট ছোট ছিদ্র করে জালের মতো বানানো হয়। এতে কম ত্বক দিয়ে বেশি এলাকা ঢাকা যায়।
ত্বক স্থাপন ও সংযুক্তকরণ
প্রস্তুত ত্বক পোড়া স্থানে স্থাপন করে সেলাই বা স্ট্যাপল দিয়ে আটকানো হয়। গ্রাফট স্থির রাখার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়:
- স্কিন গ্লু
- স্ট্যাপল বা সেলাই
- অ্যাডহেসিভ ড্রেসিং
সুরক্ষামূলক ব্যান্ডেজ
সবশেষে সুরক্ষার জন্য ব্যান্ডেজ বা ড্রেসিং দেওয়া হয়। জয়েন্টের কাছে গ্রাফট হলে নড়াচড়া কমানোর জন্য স্প্লিন্ট ব্যবহার করা হতে পারে।
বাংলাদেশে স্কিন গ্রাফটিং সুবিধা
বাংলাদেশে আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারিতে প্রক্রিয়াজাত প্রাণী বা মরদেহের ত্বক পাওয়া যায়। এছাড়াও, পরমাণুশক্তি কমিশনের আইটিবিবিআর থেকে অ্যামনিওটিক মেমব্রেন এবং অন্যান্য টিস্যু গ্রাফট সরবরাহ করা হয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ‘স্কিন ব্যাংক’ চালু হয়েছে, যা দগ্ধ রোগীদের অত্যাধুনিক চিকিৎসায় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
রোদে পোড়া ঠোঁট? এই সহজ উপায়গুলি অবলম্বন করে পান দ্রুত আরাম
চিকিৎসা পরবর্তী যত্ন ও নিরাময়
প্রাথমিক পর্যায়
গ্রাফটের পর প্রথম ৭ দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় গ্রাফটের নিচে রক্ত বা তরল জমা না হওয়া এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ করা প্রধান লক্ষ্য।
ড্রেসিং পরিবর্তন
সাতদিন পর পুরনো ব্যান্ডেজ খুলে নতুন করে ব্যান্ডেজ করা হয়। এই সময় গ্রাফটের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়।
দীর্ঘমেয়াদী যত্ন
- নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ
- সংক্রমণের লক্ষণ পর্যবেক্ষণ
- পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ
- প্রয়োজনীয় ফিজিওথেরাপি
সফলতার হার ও জটিলতা
আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে স্কিন গ্রাফটিং এর সফলতার হার যথেষ্ট ভালো। তবে কিছু জটিলতা হতে পারে:
- গ্রাফট ব্যর্থতা
- সংক্রমণ
- দাগ গঠন
- রঙের পরিবর্তন
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে স্কিন গ্রাফটিং আরও উন্নত হচ্ছে। কৃত্রিম ত্বক, স্টেম সেল থেরাপি এবং টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরও কার্যকর চিকিৎসা সম্ভব হবে।
আগুনে পোড়া রোগীদের যেভাবে স্কিন প্রতিস্থাপন করা হয় সেই পদ্ধতি আজ একটি প্রমাণিত ও কার্যকর চিকিৎসা। এই জটিল অস্ত্রোপচার হাজারো মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সাহায্য করেছে। প্রযুক্তির অগ্রগতি ও গবেষণার মাধ্যমে এই চিকিৎসা পদ্ধতি আরও উন্নত হচ্ছে। আমাদের দেশেও এই সুবিধা পৌঁছে যাওয়ায় পোড়া রোগীদের জন্য আশার আলো দেখা দিয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পেলে আগুনে পোড়া রোগীরাও নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখতে পারেন।