নতুন রেশন কার্ডের জন্য আবেদন করা এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তরের হাত ধরে অনলাইন এবং অফলাইন – দুই মাধ্যমেই আপনি আপনার পরিবারের জন্য নতুন রেশন কার্ড তৈরি করতে পারেন। এই প্রতিবেদনে আমরা ধাপে ধাপে নতুন রেশন কার্ড করার পদ্ধতি, প্রয়োজনীয় নথিপত্র, যোগ্যতা এবং অন্যান্য সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।
ডিজিটাল ইন্ডিয়ার যুগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও গণবন্টন ব্যবস্থাকে (Public Distribution System) আরও স্বচ্ছ এবং মসৃণ করতে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। এর অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ডিজিটাল রেশন কার্ড। ভর্তুকিযুক্ত খাদ্যশস্য পাওয়ার পাশাপাশি, রেশন কার্ড এখন পরিচয়পত্র এবং ঠিকানার প্রমাণপত্র হিসেবেও একটি অপরিহার্য নথি। তাই, যদি আপনার পরিবারে এখনও রেশন কার্ড না থাকে বা কোনো নতুন সদস্যের নাম যুক্ত করার প্রয়োজন হয়, তবে এই প্রতিবেদনটি আপনার জন্য।
কেন রেশন কার্ড থাকা জরুরি?
- ভর্তুকিযুক্ত খাদ্যশস্য: রেশন কার্ডের মাধ্যমে সরকার নির্ধারিত মূল্যে চাল, গম, আটা, চিনি এবং কেরোসিনের মতো অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী পাওয়া যায়।
- পরিচয়পত্র: ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, নতুন সিম কার্ড নেওয়া বা অন্যান্য সরকারি প্রকল্পে আবেদন করার ক্ষেত্রে রেশন কার্ড একটি বৈধ পরিচয়পত্র হিসেবে গ্রাহ্য হয়।
- ঠিকানার প্রমাণ: এটি আপনার স্থায়ী ঠিকানার একটি নির্ভরযোগ্য প্রমাণপত্র।
- সরকারি প্রকল্পের সুবিধা: বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পেতে রেশন কার্ড থাকা বাধ্যতামূলক।
পশ্চিমবঙ্গে কত প্রকারের রেশন কার্ড প্রচলিত আছে?
পশ্চিমবঙ্গে মূলত জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন (NFSA) এবং রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনা (RKSY) – এই দুই প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন শ্রেণীর রেশন কার্ড প্রদান করা হয়। আবেদন করার আগে আপনার পরিবারের জন্য কোন কার্ডটি প্রযোজ্য, তা জেনে নেওয়া জরুরি।
নতুন রেশন কার্ডের জন্য আবেদনের যোগ্যতা
- আবেদনকারীকে পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে।
- আবেদনকারীর পরিবারের নামে আগে থেকে কোনো ডিজিটাল রেশন কার্ড থাকা চলবে না।
- পরিবারের কোনো সদস্য সরকারি চাকরিজীবী বা আয়কর প্রদানকারী হলে, তিনি ভর্তুকিযুক্ত রেশন কার্ডের জন্য অযোগ্য বিবেচিত হতে পারেন।
- নববিবাহিত দম্পতি নতুন রেশন কার্ডের জন্য আবেদন করতে পারেন।
- পরিবারে নতুন সদস্য (যেমন নবজাতক) জন্মালে, তার নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আবেদন করা যায়।
প্রয়োজনীয় নথিপত্র: কী কী লাগবে?
নতুন রেশন কার্ডের জন্য আবেদন করতে নিম্নলিখিত নথিগুলির প্রয়োজন হবে। আবেদন করার সময় এগুলির আসল এবং জেরক্স কপি সঙ্গে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।
পরিবারের প্রধানের জন্য:
- আধার কার্ড: বর্তমানে আধার কার্ড থাকা বাধ্যতামূলক। আধার কার্ডে মোবাইল নম্বর লিঙ্ক থাকা আবশ্যক।
- পরিচয়পত্র: ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড।
- ঠিকানার প্রমাণপত্র: ইলেক্ট্রিক বিল, টেলিফোন বিল, বা ঠিকানার প্রমাণ হিসেবে গণ্য হয় এমন কোনো সরকারি নথি।
- পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
- মোবাইল নম্বর: OTP ভেরিফিকেশনের জন্য এটি অপরিহার্য।
- ইমেল আইডি (যদি থাকে)।
পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্য:
- আধার কার্ড: সকল সদস্যের আধার কার্ড থাকা বাধ্যতামূলক।
- জন্মের শংসাপত্র: ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে আধার কার্ড না থাকলে জন্মের শংসাপত্র জমা দিতে হবে।
- সদস্যদের সঙ্গে পরিবারের প্রধানের সম্পর্কের প্রমাণপত্র।
নতুন রেশন কার্ডের জন্য আবেদন পদ্ধতি (২০২৫)
আপনি মূলত দুটি উপায়ে নতুন রেশন কার্ডের জন্য আবেদন করতে পারেন: অনলাইন এবং অফলাইন।
অনলাইন আবেদন পদ্ধতি (ধাপে ধাপে)
ঘরে বসেই নিজের মোবাইল বা কম্পিউটার থেকে নতুন রেশন কার্ডের জন্য আবেদন করা সম্ভব। এর জন্য পশ্চিমবঙ্গ খাদ্য দপ্তরের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে যেতে হবে।
ধাপ ১: পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তরের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট food.wb.gov.in-এ যান।
ধাপ ২: হোমপেজে ‘Ration Card’ ট্যাবে ক্লিক করুন এবং ড্রপডাউন মেনু থেকে ‘Apply for New Ration Card’ বিকল্পটি বেছে নিন।
ধাপ ৩: আপনাকে একটি নতুন পেজে নিয়ে যাওয়া হবে। এখানে আপনাকে আপনার মোবাইল নম্বর দিতে হবে এবং ‘GET OTP’ বাটনে ক্লিক করতে হবে। আপনার মোবাইলে আসা ৪ সংখ্যার OTP টি নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে ‘PROCEED’ করুন।
ধাপ ৪: এরপর আপনার সামনে একটি ড্যাশবোর্ড খুলবে। বামদিকের মেনু থেকে ‘Apply For New Ration Card (FORM 3)’ বা ‘Apply For New Ration Card For a New Member in The Family (FORM 4)’ – আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী বিকল্পটি বেছে নিন। যদি আপনার পরিবারের কারোরই রেশন কার্ড না থাকে, তবে ফর্ম ৩ পূরণ করুন।
ধাপ ৫: ফর্মে আপনার ঠিকানা সঠিকভাবে পূরণ করুন – জেলা, ব্লক/মিউনিসিপ্যালিটি, গ্রাম পঞ্চায়েত/ওয়ার্ড, পিন কোড ইত্যাদি।
ধাপ ৬: পরিবারের প্রধানের (Head of the Family) সমস্ত তথ্য, যেমন – নাম, বাবার নাম, লিঙ্গ, জন্মতারিখ, আধার নম্বর, ভোটার কার্ড নম্বর ইত্যাদি নির্ভুলভাবে পূরণ করুন।
ধাপ ৭: এরপর ‘Add Member’ বাটনে ক্লিক করে পরিবারের বাকি সদস্যদের তথ্য একে একে যোগ করুন। প্রত্যেকের আধার নম্বর এবং অন্যান্য তথ্য সঠিকভাবে দিন।
ধাপ ৮: সমস্ত সদস্যদের তথ্য যোগ করার পর, প্রয়োজনীয় নথিপত্র (পরিবারের প্রধানের আধার কার্ড এবং ঠিকানার প্রমাণপত্র) স্ক্যান করে আপলোড করুন।
ধাপ ৯: সবশেষে, ফর্মে দেওয়া সমস্ত তথ্য একবার ভালো করে মিলিয়ে নিন এবং ‘Submit’ বাটনে ক্লিক করুন।
ধাপ ১০: আবেদনপত্র জমা হয়ে গেলে আপনি একটি অ্যাপ্লিকেশন নম্বর বা রেফারেন্স নম্বর পাবেন। এই নম্বরটি যত্ন করে রেখে দিন, কারণ এটি আপনার আবেদনের স্ট্যাটাস পরীক্ষা করতে কাজে লাগবে।
অফলাইন আবেদন পদ্ধতি
যারা অনলাইন পদ্ধতিতে স্বচ্ছন্দ নন, তারা অফলাইনেও আবেদন করতে পারেন।
ধাপ ১: আপনার নিকটবর্তী খাদ্য পরিদর্শকের অফিস (Food Inspector’s Office), বিডিও (BDO) অফিস বা বাংলা সহায়তা কেন্দ্রে (BSK) যান।
ধাপ ২: সেখান থেকে নতুন রেশন কার্ডের জন্য নির্দিষ্ট আবেদনপত্র (ফর্ম-৩ বা ফর্ম-৪) সংগ্রহ করুন। আপনি চাইলে খাদ্য দপ্তরের ওয়েবসাইট থেকেও এই ফর্ম ডাউনলোড করে প্রিন্ট করে নিতে পারেন।
ধাপ ৩: ফর্মটি নির্ভুলভাবে পূরণ করুন। পরিবারের প্রধান এবং সকল সদস্যের নাম, ঠিকানা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য লিখুন।
ধাপ ৪: আবেদনপত্রের সাথে উপরে উল্লিখিত সমস্ত প্রয়োজনীয় নথিপত্রের জেরক্স কপি সংযুক্ত করুন।
ধাপ ৫: পূরণ করা ফর্ম এবং সংযুক্ত নথিগুলি সংশ্লিষ্ট অফিসে জমা দিন।
ধাপ ৬: ফর্ম জমা দেওয়ার পর আপনি একটি রসিদ বা অ্যাকনলেজমেন্ট স্লিপ পাবেন, যাতে আপনার অ্যাপ্লিকেশন নম্বর উল্লেখ থাকবে। এটি সাবধানে রাখুন।
আবেদনের স্থিতি বা স্ট্যাটাস কিভাবে পরীক্ষা করবেন?
আবেদন করার পর আপনার রেশন কার্ডটি কোন পর্যায়ে আছে, তা আপনি সহজেই অনলাইন মাধ্যমে জানতে পারবেন।
- খাদ্য দপ্তরের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট food.wb.gov.in-এ যান।
- ‘Ration Card’ ট্যাবে ক্লিক করে ‘Check Ration Card Application Status’ বিকল্পটি বেছে নিন।
- আপনার আবেদনপত্রের ফর্মের ধরন (Form Type) নির্বাচন করুন।
- আপনার অ্যাপ্লিকেশন নম্বর বা রেজিস্টার্ড মোবাইল নম্বরটি নির্দিষ্ট স্থানে লিখুন।
- ক্যাপচা কোডটি সঠিকভাবে পূরণ করে ‘Search’ বাটনে ক্লিক করুন।
- আপনার আবেদনের বর্তমান অবস্থা স্ক্রিনে দেখতে পাবেন।
সাধারণত, আবেদনপত্র যাচাই এবং ফিল্ড ভেরিফিকেশনের পর কার্ড অনুমোদিত হলে আপনি আপনার রেজিস্টার্ড মোবাইল নম্বরে SMS-এর মাধ্যমে জানতে পারবেন।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
১. নতুন রেশন কার্ড তৈরি করতে কতদিন সময় লাগে? সাধারণত, আবেদন করার পর ১৫ থেকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে রেশন কার্ড তৈরি হয়ে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে যাচাই প্রক্রিয়ার জন্য সময় বেশি লাগতে পারে।
২. আধার কার্ড ছাড়া কি নতুন রেশন কার্ডের জন্য আবেদন করা যাবে? না, বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আধার কার্ড থাকা বাধ্যতামূলক। তবে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে জন্মের শংসাপত্র দিয়ে আবেদন করা যায়, কিন্তু ৫ বছর বয়স হওয়ার পরে তাদের আধার তথ্য আপডেট করতে হবে।
৩. আমার পরিবারের রেশন কার্ড আছে, কিন্তু নতুন সদস্যের নাম কিভাবে যোগ করব? এর জন্য আপনাকে ফর্ম-৪ পূরণ করে অনলাইন বা অফলাইনে আবেদন করতে হবে। নবজাতকের ক্ষেত্রে তার জন্মের শংসাপত্র এবং নববধূর ক্ষেত্রে তার বাবার বাড়ির রেশন কার্ড থেকে নাম তোলার সার্টিফিকেট (Surrender Certificate) এবং বিয়ের প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে।
৪. রেশন কার্ড হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে কী করব? আপনি ডুপ্লিকেট রেশন কার্ডের জন্য নির্দিষ্ট ফর্মে আবেদন করতে পারেন অথবা অনলাইন পোর্টাল থেকে ই-রেশন কার্ড ডাউনলোড করে প্রিন্ট করে নিতে পারেন।
৫. রেশন কার্ড সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ থাকলে কোথায় জানাব? আপনি পশ্চিমবঙ্গ খাদ্য দপ্তরের টোল-ফ্রি হেল্পলাইন নম্বর 1967 বা 1800 345 5505 -এ ফোন করে আপনার অভিযোগ জানাতে পারেন।
রেশন কার্ড শুধুমাত্র ভর্তুকিযুক্ত খাদ্যশস্য পাওয়ার একটি মাধ্যম নয়, এটি একজন নাগরিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়পত্র। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহজ ও সরল আবেদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আপনি এখন সহজেই আপনার পরিবারের জন্য এই অপরিহার্য নথিটি তৈরি করে নিতে পারেন। আশা করি, এই প্রতিবেদনটি আপনাকে নতুন রেশন কার্ড তৈরির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি বুঝতে সাহায্য করেছে।