বৃষ্টি হলেই ছাদ বাগানে শামুকের উপদ্রব? জানুন মোকাবিলার কার্যকরী উপায়

how to control snails in garden: বর্ষা মানেই ছাদ বাগানে সবুজের সমারোহ, সতেজ গাছপালা আর একরাশ ভালো লাগা। কিন্তু এই স্বস্তির মরসুমেই শখের বাগানে হানা দেয় এক নীরব শত্রু—শামুক। বৃষ্টিভেজা…

Riddhi Datta

 

how to control snails in garden: বর্ষা মানেই ছাদ বাগানে সবুজের সমারোহ, সতেজ গাছপালা আর একরাশ ভালো লাগা। কিন্তু এই স্বস্তির মরসুমেই শখের বাগানে হানা দেয় এক নীরব শত্রু—শামুক। বৃষ্টিভেজা স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় এদের উপদ্রব বাড়ে এবং রাতারাতি কচি পাতা, চারাগাছ ও সবজি খেয়ে শেষ করে দেয়। এই snail infestation in rooftop garden সমস্যাটি সকল ছাদ বাগানীদের জন্যই এক বড় মাথাব্যথার কারণ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শহরাঞ্চলে ছাদ বাগানের জনপ্রিয়তা বাড়ার সাথে সাথে শামুকের উপদ্রবও একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। যদিও পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশে ছাদ বাগানে শামুকের আক্রমণে ক্ষতির নির্দিষ্ট কোনো আর্থিক পরিসংখ্যান নেই, তবে কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, সঠিক সময়ে ব্যবস্থা না নিলে উৎপাদনের প্রায় ১৫-২০% পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে, জায়ান্ট আফ্রিকান শামুক (Giant African Snail) এর মতো প্রজাতিগুলো অল্প সময়ে ব্যাপক ক্ষতি করতে সক্ষম। দ্য হিন্দু পত্রিকার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের বিভিন্ন অংশে এই প্রজাতির শামুক কৃষিতে বড় সমস্যা তৈরি করছে।

এই নিবন্ধে আমরা ছাদ বাগানে শামুকের উপদ্রবের কারণ, এর ক্ষতিকর প্রভাব এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, এটি নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন জৈব, যান্ত্রিক ও রাসায়নিক উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

ছাদ বাগানে কেন শামুকের উপদ্রব বাড়ে? 

শামুক মূলত আর্দ্র এবং ছায়াময় পরিবেশ পছন্দ করে। বর্ষাকালে ছাদ বাগানে এদের বংশবিস্তার এবং আক্রমণের জন্য আদর্শ পরিস্থিতি তৈরি হয়। এর প্রধান কারণগুলো হলো:

  • অতিরিক্ত আর্দ্রতা: একটানা বৃষ্টিপাতের ফলে টবের মাটি এবং ছাদের বিভিন্ন কোণ দীর্ঘ সময় ধরে ভেজা থাকে। এই স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ শামুকের চলাফেরা ও প্রজননের জন্য অত্যন্ত অনুকূল।
  • খাদ্যের প্রাচুর্য: ছাদ বাগানে থাকা কচি পাতা, নরম কান্ড, চারাগাছ এবং পচনশীল জৈব পদার্থ শামুকের প্রধান খাদ্য। বর্ষাকালে গাছের দ্রুত বৃদ্ধি এদের খাদ্যের জোগান বাড়িয়ে দেয়।
  • লুকানোর জায়গা: টবের নিচে, ইটের ফাঁকে, পুরনো প্লাস্টিক বা আগাছার ঝোপ—এইসব জায়গায় শামুক দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকে এবং রাতের অন্ধকারে বা মেঘলা দিনে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
  • তাপমাত্রা: বর্ষার শীতল আবহাওয়া শামুকের সক্রিয়তার জন্য আদর্শ। গ্রীষ্মের প্রখর রোদে এরা নিজেদের খোলসের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, কিন্তু বর্ষায় তাপমাত্রা কমতেই বেরিয়ে আসে।

শামুকের আক্রমণে গাছের কী কী ক্ষতি হয়?

শামুকের আক্রমণ খালি চোখে অনেক সময় বোঝা যায় না, কারণ এরা নিশাচর। কিন্তু সকালে বাগানে গেলেই এদের ধ্বংসলীলার চিহ্ন স্পষ্ট দেখা যায়।

  • পাতায় ছিদ্র: এরা গাছের কচি পাতা ধারালো দাঁতের মতো অঙ্গ (Radula) দিয়ে কুরে কুরে খায়, যার ফলে পাতায় বড় বড় অনিয়মিত ছিদ্র তৈরি হয়।
  • চারাগাছ নষ্ট: নরম চারাগাছ এদের সবচেয়ে পছন্দের খাদ্য। অনেক সময় এরা পুরো চারাগাছটাই খেয়ে ফেলে, ফলে নতুন লাগানো গাছ বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।
  • ফল ও সবজির ক্ষতি: ফল বা সবজি, বিশেষ করে যেগুলো মাটির কাছাকাছি থাকে (যেমন স্ট্রবেরি, লেটুস, শসা), সেগুলোতে এরা গর্ত করে দেয়। এর ফলে ফসল খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে এবং ছত্রাকের আক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে।
  • স্লাইম ট্রেইল (Slime Trail): শামুক চলার পথে এক ধরনের রুপোলি রঙের আঠালো পদার্থ ফেলে যায়, যা শুকিয়ে গেলে চকচক করে। এটি গাছে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ ছড়াতে সাহায্য করে।

শামুক নিয়ন্ত্রণের কার্যকরী এবং পরিবেশবান্ধব উপায়

ছাদ বাগানে শামুক নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব বা যান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করা সবসময়ই শ্রেয়। কারণ রাসায়নিক পদার্থ সবজি ও ফলের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে এবং পরিবেশের উপকারী পোকামাকড়েরও ক্ষতি করে। নিচে কিছু পরীক্ষিত ও কার্যকরী পদ্ধতির আলোচনা করা হলো।

১. যান্ত্রিক ও কায়িক পদ্ধতি (Mechanical Control)

  • হাতে ধরে নির্মূল করা: এটি সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকরী পদ্ধতি। সন্ধ্যায় বা খুব ভোরে টর্চলাইট নিয়ে বাগানে গেলে শামুকদের সক্রিয় অবস্থায় পাওয়া যায়। দস্তানা পরে বা চিমটার সাহায্যে এদের ধরে সাবান জলে বা লবণ জলে ডুবিয়ে মারতে পারেন।
  • আশ্রয়স্থল পরিষ্কার রাখা: টবের নিচে, ইটের ফাঁক, পুরনো পাত্র বা অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জমতে দেবেন না। বাগান যত পরিষ্কার ও খোলামেলা রাখবেন, শামুকের লুকানোর জায়গা তত কমবে।
  • বিয়ারের ফাঁদ (Beer Trap): শামুক বিয়ারের গন্ধে আকৃষ্ট হয়। একটি ছোট পাত্র (যেমন দইয়ের কাপ) মাটির সমান করে পুঁতে দিন এবং তার অর্ধেকটা বিয়ার দিয়ে ভরে দিন। শামুক এর মধ্যে পড়ে ডুবে মারা যাবে। প্রতি ২-৩ দিন অন্তর এই ফাঁদ পরিষ্কার করতে হবে।
  • প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক (Natural Barriers): টবের চারপাশে বা গাছের গোড়ায় এমন কিছু জিনিস ছড়িয়ে দিতে পারেন যা শামুক অতিক্রম করতে পারে না। যেমন:
    • ডিমের খোসার গুঁড়ো: ডিমের খোসার ধারালো কণা শামুকের নরম শরীরের জন্য অস্বস্তিদায়ক।
    • কফির গুঁড়ো: কফির ক্যাফেইন শামুকের জন্য বিষাক্ত এবং এর গন্ধও তারা পছন্দ করে না।
    • কাঠের ছাই বা বালি: এই খসখসে জিনিসগুলো শামুকের পথচলায় বাধা সৃষ্টি করে।
    • কপার টেপ (Copper Tape): টবের চারপাশে কপারের টেপ লাগিয়ে দিলে শামুক তা পার হতে পারে না। শামুকের শরীর থেকে নিঃসৃত শ্লেষ্মা কপারের সাথে বিক্রিয়া করে একটি মৃদু বৈদ্যুতিক শক তৈরি করে, যা তাদের দূরে রাখে।

২. জৈব নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি (Organic & Biological Control)

  • নিম তেল স্প্রে: এক লিটার জলে ৫ মিলি নিম তেল এবং সামান্য তরল সাবান মিশিয়ে গাছের পাতায় ও মাটিতে স্প্রে করলে শামুক দূরে থাকে।
  • রসুন স্প্রে: কয়েক কোয়া রসুন থেঁতো করে জলে ফুটিয়ে ঠান্ডা করে নিন। এই জল স্প্রে করলেও শামুকের উপদ্রব কমে।
  • উপকারী বন্ধুকে আমন্ত্রণ: ছাদ বাগানে যদি সম্ভব হয়, তবে হাঁস বা মুরগি ছেড়ে দিলে তারা শামুক এবং এদের ডিম খেয়ে বাগান পরিষ্কার রাখে। ব্যাঙ এবং কিছু পাখিও শামুকের প্রাকৃতিক শত্রু।
  • ফেরোমোন ট্র্যাপ: কিছু ক্ষেত্রে ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করে শামুককে আকৃষ্ট করে এক জায়গায় জড়ো করে মেরে ফেলা হয়। তামিলনাড়ু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (TNAU) এই ধরনের বিভিন্ন ফাঁদ এবং বিষটোপ ব্যবহারের পরামর্শ দেয়।

৩. রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ (Chemical Control – সতর্কতার সাথে ব্যবহার্য)

যদি কোনোভাবেই শামুকের উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে শেষ উপায় হিসেবে রাসায়নিক ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ছাদ বাগানে, বিশেষ করে যেখানে সবজি চাষ হয়, সেখানে মেটালডিহাইড (Metaldehyde) যুক্ত টোপ ব্যবহার না করাই ভালো। কারণ এটি পোষ্য প্রাণী এবং মানুষের জন্য বিষাক্ত।

এর পরিবর্তে আয়রন ফসফেট (Iron Phosphate) যুক্ত শামুকনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে, যা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। এই টোপ খাওয়ার পর শামুক খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং ৩-৬ দিনের মধ্যে মারা যায়। যেকোনো রাসায়নিক ব্যবহারের আগে প্যাকেটের নির্দেশাবলী ভালোভাবে পড়ে নেবেন।

বিশেষজ্ঞদের মতামত ও সুপারিশ

কৃষি বিশেষজ্ঞরা সবসময় একটি সমন্বিত কীট ব্যবস্থাপনা (Integrated Pest Management – IPM) পদ্ধতির ওপর জোর দেন। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার IPM প্রোগ্রাম অনুসারে, শুধুমাত্র একটি পদ্ধতির ওপর নির্ভর না করে একাধিক পদ্ধতি একসাথে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। যেমন:

  • সকালের দিকে জল দিন: সন্ধ্যায় গাছে জল দিলে মাটি বেশিক্ষণ ভেজা থাকে, যা শামুকের জন্য আদর্শ। তাই চেষ্টা করুন সকালে জল দেওয়ার, যাতে দিনের বেলায় মাটি কিছুটা শুকিয়ে যায়।
  • গাছের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখুন: টবগুলো খুব কাছাকাছি রাখলে हवा চলাচল কমে যায় এবং আর্দ্রতা বেড়ে যায়। তাই টবগুলোর মধ্যে পর্যাপ্ত ফাঁকা জায়গা রাখুন।
  • প্রতিরোধী গাছ লাগান: কিছু গাছ আছে যেগুলোর গন্ধ বা পাতার গঠন শামুক পছন্দ করে না। যেমন—রোজমেরি, ল্যাভেন্ডার, গাঁদা, পুদিনা ইত্যাদি। আপনার বাগানে এই গাছগুলো লাগাতে পারেন।

উপসংহার

ছাদ বাগানে snail infestation in rooftop garden একটি সাধারণ কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য সমস্যা। বর্ষাকালে একটু বাড়তি সতর্কতা এবং সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করলেই এই উপদ্রব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। রাসায়নিকের ওপর নির্ভর না করে জৈব ও যান্ত্রিক পদ্ধতিগুলোকে অগ্রাধিকার দিলে তা আপনার বাগান, পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হবে। মনে রাখবেন, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাই হলো শামুকমুক্ত একটি সুন্দর ছাদ বাগানের চাবিকাঠি।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ Section)

১. শামুক তাড়ানোর সবচেয়ে দ্রুত উপায় কী?

উত্তর: সবচেয়ে দ্রুত উপায় হলো সন্ধ্যায় বা বৃষ্টির পর টর্চলাইট নিয়ে বাগান থেকে হাতে ধরে শামুক সংগ্রহ করে ফেলা এবং লবণ জল বা সাবান জলে ডুবিয়ে দেওয়া।

২. ডিমের খোসা কি সত্যিই শামুক তাড়াতে পারে?

উত্তর: হ্যাঁ, পারে। ডিমের খোসা গুঁড়ো করে গাছের গোড়ায় ছড়িয়ে দিলে এর ধারালো কণা শামুকের নরম ত্বকের জন্য অস্বস্তিকর হওয়ায় তারা ওই জায়গা এড়িয়ে চলে।

৩. কফি গুঁড়ো কীভাবে ব্যবহার করব?

উত্তর: ব্যবহৃত বা তাজা কফির গুঁড়ো সরাসরি টবের মাটির উপরে বা গাছের চারপাশে একটি বৃত্তাকারে ছড়িয়ে দিন। এর গন্ধ এবং ক্যাফেইন শামুককে দূরে রাখতে সাহায্য করে।

৪. ছাদ বাগানে শামুকের ডিম কোথায় খুঁজে পাওয়া যায়?

উত্তর: শামুক সাধারণত ভেজা মাটির সামান্য নিচে, টবের কিনারায়, বা পাতার নিচে স্বচ্ছ, জেলির মতো থোকায় ডিম পাড়ে। মাটি আলগা করার সময় এই ডিমগুলো নষ্ট করে দিন।

৫. লবণ ছিটিয়ে কি শামুক মারা যায়? এটি কি গাছের জন্য ক্ষতিকর?

উত্তর: সরাসরি শামুকের গায়ে লবণ ছিটিয়ে দিলে ডিহাইড্রেশনের কারণে তারা মারা যায়। কিন্তু টবের মাটিতে বেশি লবণ ব্যবহার করলে গাছের শিকড়ের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে এবং মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। তাই এই পদ্ধতি এড়িয়ে চলাই ভালো।

৬. বর্ষা শেষ হলে কি শামুকের উপদ্রব কমে যায়?

উত্তর: হ্যাঁ, সাধারণত বর্ষা শেষে মাটি শুষ্ক হতে শুরু করলে এবং তাপমাত্রা বাড়লে শামুকের উপদ্রব অনেকটাই কমে যায়। তবে এদের ডিম মাটিতে থেকে যেতে পারে, যা পরের বর্ষায় আবার সমস্যা তৈরি করে।

About Author
Riddhi Datta

ঋদ্ধি দত্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি একজন উদীয়মান বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, যিনি জটিল বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলিকে সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য করে তোলেন। তাঁর লেখায় রসায়ন, পরিবেশ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সমসাময়িক বিষয়গুলি প্রাধান্য পায়। ঋদ্ধি নিয়মিতভাবে এই ওয়েবসাইটে বিজ্ঞান-ভিত্তিক প্রবন্ধ, গবেষণা সারসংক্ষেপ এবং বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেন।