বাড়ির আনাচে-কানাচে, বিশেষ করে স্যাঁতসেঁতে ভেজা জায়গায় হঠাৎ করেই গা শিরশিরে এক প্রাণীটির দেখা মেলে—চেলা বা কেন্নো। বহু পা ওয়ালা এই দ্রুতগামী প্রাণীটি দেখতে যেমন অস্বস্তিকর, তেমনই এর কামড় বেশ যন্ত্রণাদায়ক। বর্ষাকালে বা আর্দ্র আবহাওয়ায় এদের উপদ্রব বাড়ে। যদিও বেশিরভাগ চেলার কামড় মারাত্মক নয়, তবে তা তীব্র ব্যথা, ফোলাভাব এবং অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর পোকামাকড়ের কামড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হন, যার মধ্যে চেলার কামড়ও অন্যতম। সঠিক তথ্য ও সচেতনতার অভাবে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এই বিশদ প্রবন্ধে আমরা বিষাক্ত চেলা দূর করার উপায় (poisonous centipede control) এবং এর কামড়ের পর করণীয় সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তথ্য ও বিশেষজ্ঞের মতামত তুলে ধরব।
বর্ষার স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় প্রায়শই আমাদের বাড়িতে নানা ধরনের পোকামাকড়ের আনাগোনা বেড়ে যায়। এদের মধ্যে অন্যতম এক আতঙ্ক হলো চেলা, যা Scolopendra
গণের অন্তর্ভুক্ত। এরা মূলত নিশাচর এবং বাড়ির অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে স্থান যেমন বাথরুম, রান্নাঘরের সিঙ্ক, পুরনো আসবাবের খাঁজ বা বাগানে থাকতে ভালোবাসে। এরা শিকার ধরার জন্য বিষাক্ত নখর ব্যবহার করে, যা forcipules
নামে পরিচিত। মানুষ সাধারণত ভুলবশত এদের সংস্পর্শে এলেই কামড়ের শিকার হয়। যদিও ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন (NCBI) অনুসারে, চেলার কামড়ে মৃত্যু অত্যন্ত বিরল, তবে এর বিষে histamine
, serotonin
এবং বিভিন্ন cardio-depressant toxin
থাকায় তীব্র ব্যথা, ফোলা ও চামড়ায় লালচে ভাব দেখা দেয়। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক এবং অ্যালার্জির সমস্যায় ভোগা ব্যক্তিদের জন্য এর কামড় মারাত্মক হতে পারে। তাই এই পোকাটি চেনা এবং এর থেকে সুরক্ষিত থাকার উপায় জানা অত্যন্ত জরুরি।
চেলার উপদ্রব: কারণ ও প্রেক্ষাপট
চেলা বা poisonous centipede
কেন আপনার বাড়িতে বাসা বাঁধে, তা জানা প্রয়োজন। এর প্রধান কারণগুলো হলো:
- আর্দ্রতা: চেলা বেঁচে থাকার জন্য আর্দ্র পরিবেশ পছন্দ করে। বাড়ির যেসব জায়গায় জল জমে থাকে বা স্যাঁতসেঁতে থাকে, যেমন—বেসিন বা সিঙ্কের পাইপ, ড্রেন, ভেজা বাথরুম, বা বেসমেন্ট, সেখানেই এরা বংশবৃদ্ধি করে।
- খাবারের উৎস: চেলার প্রধান খাদ্য হলো ছোট ছোট পোকা, মাকড়সা, আরশোলা এবং কেঁচো। আপনার বাড়িতে যদি অন্য পোকামাকড়ের উপদ্রব থাকে, তবে চেলা তাদের শিকার করতে আসবেই।
- আশ্রয়স্থল: বাড়ির আবর্জনা, পুরনো বাক্স, কাঠের স্তূপ, পাতার গাদা, বা বাগানের পাথরের নিচে এদের জন্য আদর্শ আশ্রয়স্থল। অন্ধকার এবং নিরিবিলি স্থান এদের বেশি পছন্দের।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশে, Scolopendra subspinipes
এবং Scolopendra hardwickei
-এর মতো বড় আকারের বিষাক্ত প্রজাতির চেলার দেখা মেলে। এদের কামড় তুলনামূলকভাবে বেশি যন্ত্রণাদায়ক।
বিষাক্ত চেলার (Poisonous Centipede) কামড়ের লক্ষণ ও প্রাথমিক চিকিৎসা
চেলার কামড় মৌমাছি বা বোলতার হুলের মতোই বেদনাদায়ক। কামড়ের পর সাধারণত নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা যায়:
- কামড়ের জায়গায় দুটি ছোট ক্ষতচিহ্ন।
- তীব্র জ্বালা বা ছুরির মতো ধারালো ব্যথা।
- ক্ষতস্থান লাল হয়ে ফুলে যাওয়া।
- চুলকানি এবং অসাড়তা।
গুরুতর ক্ষেত্রে বা অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়ায় নিচের লক্ষণগুলোও প্রকাশ পেতে পারে:
- মাথাব্যথা ও বমি বমি ভাব।
- হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া।
- শ্বাসকষ্ট।
- লিম্ফ নোড বা লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কামড়ানোর সাথে সাথে আতঙ্কিত না হয়ে কিছু প্রাথমিক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত:
- ক্ষতস্থান পরিষ্কার করুন: মাউন্ট সিনাই হসপিটালের পরামর্শ অনুযায়ী, ক্ষতস্থানটি সাবান ও জল দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে যাতে সংক্রমণের ঝুঁকি কমে।
- বরফ প্রয়োগ করুন: একটি পরিষ্কার কাপড়ে বরফ জড়িয়ে ক্ষতস্থানে ১০-১৫ মিনিট ধরে রাখুন। এটি ব্যথা এবং ফোলা কমাতে সাহায্য করবে।
- ব্যথানাশক ওষুধ: ব্যথা কমাতে চিকিৎসকের পরামর্শে
acetaminophen
বাibuprofen
জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। - অ্যান্টিহিস্টামিন: চুলকানি বা হালকা অ্যালার্জির জন্য
antihistamine
ক্রিম বা ট্যাবলেট গ্রহণ করা যেতে পারে। - টিটেনাস আপডেট: ক্ষত গভীর হলে বা গত ১০ বছরে টিটেনাস টিকা না নেওয়া থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে টিকা নিন।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
যদি শ্বাসকষ্ট, তীব্র মাথা ঘোরা, অস্বাভাবিক ফোলাভাব বা অ্যালার্জির গুরুতর লক্ষণ দেখা দেয়, তবে অবিলম্বে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করুন। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি না নিয়ে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াই শ্রেয়।
বাড়ি থেকে চেলা দূর করার প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক উপায়
বাড়িতে চেলার উপদ্রব কমাতে প্রাকৃতিক এবং রাসায়নিক—দুই ধরনের পদ্ধতিই ব্যবহার করা যায়।
প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া পদ্ধতি (Poisonous Centipede Repellents)
- আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ: বাড়ির স্যাঁতসেঁতে জায়গাগুলো শুকনো রাখার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে
dehumidifier
ব্যবহার করুন। বাথরুম ব্যবহারের পর ভেন্টিলেশন ফ্যান চালিয়ে দিন। - প্রবেশ পথ বন্ধ করুন: বাড়ির দেওয়ালে বা মেঝেতে থাকা ফাটল, দরজা-জানালার ফাঁক
sealant
বা সিমেন্ট দিয়ে বন্ধ করে দিন। নর্দমার মুখে জাল লাগিয়ে দিন। - আবর্জনা পরিষ্কার: বাড়ির ভেতর ও বাইরে আবর্জনার স্তূপ, পুরনো কাঠের গাদা, বা শুকনো পাতার গাদা জমতে দেবেন না। এগুলোই চেলার থাকার জায়গা।
- বোরিক অ্যাসিড: আরশোলা বা অন্যান্য পোকা দমনের জন্য ব্যবহৃত বোরিক অ্যাসিড চেলার ক্ষেত্রেও কার্যকরী। বাড়ির কোণায়, আলমারির নিচে বা সিঙ্কের চারপাশে অল্প পরিমাণে ছড়িয়ে দিন। তবে বাড়িতে শিশু বা পোষ্য প্রাণী থাকলে এটি ব্যবহারে সতর্ক থাকুন।
- এসেনশিয়াল অয়েল: মেন্থল বা পেপারমিন্ট তেলের তীব্র গন্ধ চেলা সহ্য করতে পারে না। এক কাপ জলে কয়েক ফোঁটা পেপারমিন্ট অয়েল মিশিয়ে স্প্রে বোতলে ভরে নিন। এরপর বাড়ির বিভিন্ন কোণায় এবং চেলার সম্ভাব্য প্রবেশপথে স্প্রে করুন।
- বাসন ধোয়ার সাবান: তিন লিটার জলে দুই চামচ বাসন ধোয়ার তরল সাবান মিশিয়ে একটি স্প্রে তৈরি করুন। এটি সরাসরি চেলার গায়ে স্প্রে করলে তাদের শ্বাসরোধ হয়ে মারা যায়। এই মিশ্রণটি বাড়ির অন্ধকার কোণগুলোতেও ছিটিয়ে দিতে পারেন, যেমনটি আনন্দবাজার পত্রিকা-র একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাসায়নিক পদ্ধতি
যদি প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কাজ না হয় এবং উপদ্রব খুব বেশি থাকে, তবে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
- কীটনাশক স্প্রে: বাজারে বিভিন্ন ধরনের
insecticide spray
পাওয়া যায় যা চেলা দমনে কার্যকর। ব্যবহারের আগে প্যাকেজের নির্দেশাবলী ভালোভাবে পড়ে নিন এবং শিশু ও পোষ্যদের নাগাল থেকে দূরে রাখুন। - পেশাদার পেস্ট কন্ট্রোল: যদি উপদ্রব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে পেশাদার পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিসের সাহায্য নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তারা চেলার উৎস খুঁজে বের করে কার্যকরভাবে দমন করতে পারে।
সমাজ ও জীবনযাত্রার উপর প্রভাব
যদিও চেলা সরাসরি কোনো বড় রোগ ছড়ায় না, তবে বাড়িতে এর উপস্থিতি মানসিক অস্বস্তি ও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে যে বাড়িতে শিশু আছে, সেখানে অভিভাবকরা সর্বদা চিন্তিত থাকেন। এর কামড়ের ফলে সৃষ্ট শারীরিক যন্ত্রণা দৈনন্দিন কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং পোকামাকড়মুক্ত পরিবেশ স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার একটি অপরিহার্য অংশ, এবং চেলার উপদ্রব সেই ভারসাম্য নষ্ট করে।
ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গি ও সুপারিশ
জলবায়ু পরিবর্তন এবং নগরায়নের ফলে পোকামাকড়ের বাস্তুতন্ত্রে পরিবর্তন আসছে। ভবিষ্যতে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পরিকল্পিত নগরায়ন না হলে এ ধরনের প্রাণীর উপদ্রব আরও বাড়তে পারে।
সুপারিশ:
- নিয়মিত বাড়িঘর ও আশপাশ পরিষ্কার রাখুন।
- বাড়িতে জল জমার উৎস বন্ধ করুন।
- অন্যান্য পোকামাকড়ের উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করুন, কারণ তারাই চেলার খাদ্য।
- চেলার কামড়ের প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে জেনে রাখুন।
সাধারণ জিজ্ঞাস্য (FAQ Section)
১. চেলার কামড় কি প্রাণঘাতী?
উত্তর: না, চেলার কামড় সাধারণত প্রাণঘাতী নয়। এর বিষ যন্ত্রণাদায়ক হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা মারাত্মক হয় না। তবে শিশু, বয়স্ক বা যাদের অ্যালার্জির সমস্যা রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা যেতে পারে।
২. চেলা কি ইচ্ছে করে মানুষকে কামড়ায়?
উত্তর: না, চেলা আগ্রাসী প্রাণী নয়। তারা সাধারণত আত্মরক্ষার জন্যই কামড়ায়। যখন মানুষ অসাবধানতাবশত তাদের গায়ে হাত দেয় বা তাদের বিরক্ত করে, তখনই তারা কামড় দেয়।
৩. বাড়িতে চেলা থাকা কি ভালো?
উত্তর: চেলা আরশোলা, মাকড়সা এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক পোকা খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে। তবে বাড়ির ভেতরে এদের উপস্থিতি কামড়ের ঝুঁকির কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত।
৪. চেলার বিষ নামানোর কোনো উপায় আছে কি?
উত্তর: “বিষ নামানো” একটি প্রচলিত ধারণা। বৈজ্ঞানিকভাবে, চেলার বিষের কোনো নির্দিষ্ট antivenom নেই। এর চিকিৎসা মূলত লক্ষণভিত্তিক, অর্থাৎ ব্যথা, ফোলা এবং অ্যালার্জির উপসর্গ কমানোর উপর জোর দেওয়া হয়।
৫. চেলা এবং কেন্নোর মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর: চেলা (Centipede) এবং কেন্নো (Millipede) দেখতে একরকম হলেও দুটি ভিন্ন প্রাণী। চেলার প্রতিটি দেহখণ্ডে এক জোড়া পা থাকে এবং এরা মাংসাশী ও বিষাক্ত। অন্যদিকে, কেন্নোর প্রতিটি খণ্ডে দুই জোড়া পা থাকে এবং এরা মূলত পচা উদ্ভিদ খেয়ে বেঁচে থাকে ও বিষাক্ত নয়।
উপসংহার
চেলা বা poisonous centipede
একটি উপদ্রবকারী প্রাণী এবং এর কামড় যন্ত্রণাদায়ক। তবে আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সহজেই এর উপদ্রব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। বাড়ির পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও শুষ্ক রাখা, পোকামাকড়ের প্রবেশপথ বন্ধ করা এবং প্রাথমিক চিকিৎসার নিয়মগুলো জেনে রাখাই হলো চেলামুক্ত থাকার সেরা উপায়। মনে রাখবেন, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। গুরুতর কোনো উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।