মহাকাশে মানুষের সঙ্গী: যে প্রাণীরা আমাদের অবাক করে

মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে শুধু মানুষই নয়, বেশ কিছু প্রাণীও পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে মহাশূন্যে পাড়ি দিয়েছে। এই প্রাণীদের মধ্যে কিছু এমন আছে, যাদের নাম শুনলে আমরা অবাক না হয়ে পারি না।…

Srijita Chattopadhay

 

মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে শুধু মানুষই নয়, বেশ কিছু প্রাণীও পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে মহাশূন্যে পাড়ি দিয়েছে। এই প্রাণীদের মধ্যে কিছু এমন আছে, যাদের নাম শুনলে আমরা অবাক না হয়ে পারি না। কুকুর-বিড়ালের মতো পরিচিত প্রাণী থেকে শুরু করে মাকড়সা, মাছি বা এমনকি কেঁচো পর্যন্ত—মহাকাশে গিয়েছে এমন প্রাণীর তালিকা বেশ দীর্ঘ। এই প্রাণীগুলো কেবল মহাকাশে ভ্রমণই করেনি, বরং বিজ্ঞানীদের গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের এই অভিযান মানুষের জন্য মহাকাশে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা যাচাই করতে সাহায্য করেছে।

ঘটনার শুরু হয়েছিল গত শতাব্দীর মাঝামাঝি, যখন মানুষ এখনো মহাকাশে পা রাখার স্বপ্ন দেখছিল। প্রথম দিকে বিজ্ঞানীরা জানতেন না যে মহাকাশের পরিবেশে জীবন টিকে থাকা সম্ভব কি না। তাই তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রাণীকে বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে আমেরিকার বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো ফলের মাছি পাঠান মহাকাশে। এরপর থেকে কুকুর, বানর, ইঁদুর, মাকড়সা—এমনকি জলজ প্রাণী পর্যন্ত মহাকাশে গেছে। এই প্রাণীদের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মহাকাশের মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থা, রেডিয়েশন এবং অন্যান্য পরিবেশের প্রভাব পরীক্ষা করেছেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পাঠানো কুকুর লাইকা ১৯৫৭ সালে প্রথম প্রাণী হিসেবে পৃথিবীর কক্ষপথে প্রবেশ করে, যদিও সে ফিরে আসতে পারেনি। এই অভিযানগুলোর পেছনে ছিল মানুষের জন্য মহাকাশকে নিরাপদ করার লক্ষ্য।

বিস্ময়ের বিষয় হলো, শুধু বড় প্রাণীই নয়, ছোট ছোট জীবও মহাকাশে গিয়েছে। ১৯৭৩ সালে নাসা দুটি মাকড়সা, অ্যারাবেলা এবং অনিতা, পাঠায় স্কাইল্যাব-৩ মিশনে। এই মাকড়সারা মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থায় জাল বুনতে পারে কি না, তা পরীক্ষা করাই ছিল লক্ষ্য। প্রথমে তারা একটু বিভ্রান্ত হলেও পরে সুন্দর জাল বুনে বিজ্ঞানীদের অবাক করে দেয়। এছাড়া ২০০৩ সালে কলাম্বিয়া স্পেস শাটলের মাধ্যমে কেঁচো পাঠানো হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত, সেই মিশনটি পৃথিবীতে ফেরার সময় বিপর্যয়ের মুখে পড়ে, কিন্তু পরে ধ্বংসাবশেষ থেকে কেঁচোগুলো জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে ছোট প্রাণীও মহাকাশের কঠিন পরিবেশে টিকে থাকতে পারে।

আরেকটি মজার তথ্য হলো, মাছের মতো জলজ প্রাণীও মহাকাশে গিয়েছে। ১৯৭৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে পাঠায় কিলিফিশ নামের একটি ছোট মাছ। এই মাছগুলো মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থায় সাঁতার কাটতে পারে কি না, তা দেখা ছিল গবেষণার উদ্দেশ্য। আশ্চর্যজনকভাবে, তারা স্বাভাবিকভাবেই সাঁতার কেটেছে, যদিও প্রথমে একটু অস্থির ছিল। এছাড়া ফলের মাছি বা ড্রসোফিলা মহাকাশ গবেষণায় বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। এদের দ্রুত প্রজনন ক্ষমতার কারণে বিজ্ঞানীরা মহাকাশে জিনগত পরিবর্তন পরীক্ষা করতে এদের বেছে নিয়েছিলেন। এই প্রাণীগুলোর অবদানের কারণেই আজ আমরা মহাকাশে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী।

এই প্রাণীদের মহাকাশ অভিযানের পেছনে রয়েছে বৈজ্ঞানিক কৌতূহল এবং মানবজাতির উন্নতি। উদাহরণস্বরূপ, লাইকার মিশন থেকে বিজ্ঞানীরা শিখেছিলেন যে মহাকাশে জীবন টিকে থাকা সম্ভব, যদিও সেই সময় প্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না যে তাকে ফিরিয়ে আনা যায়। পরবর্তীতে আমেরিকা ১৯৬১ সালে চিম্পাঞ্জি হ্যামকে মহাকাশে পাঠায় এবং সফলভাবে ফিরিয়ে আনে। এই ঘটনা মানুষের মহাকাশে যাওয়ার পথ আরো প্রশস্ত করে। আজকের দিনে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) বিভিন্ন প্রাণী নিয়ে গবেষণা চলছে। ২০১৩ সালে এমনকি টার্ডিগ্রেড বা ওয়াটার বেয়ার নামের একটি ক্ষুদ্র প্রাণীও মহাকাশে পাঠানো হয়েছে, যারা চরম পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, এই প্রাণীদের অবদান ছাড়া মহাকাশ গবেষণা এতদূর এগোত না। তাদের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা জেনেছেন যে মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থায় জীবন কীভাবে কাজ করে, রেডিয়েশনের প্রভাব কতটা এবং জীবনের মৌলিক প্রক্রিয়াগুলো কীভাবে চলে। এই তথ্যগুলো শুধু মানুষের জন্যই নয়, ভবিষ্যতে অন্য গ্রহে জীবনের সম্ভাবনা খুঁজতেও সাহায্য করবে। তাই পরের বার যখন মহাকাশের কথা ভাববেন, শুধু নভোচারীদের কথাই নয়, এই নীরব প্রাণীদের কথাও মনে রাখবেন, যারা আমাদের জন্য পথ দেখিয়েছে।

About Author
Srijita Chattopadhay

সৃজিতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক। তিনি একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক এবং সাংবাদিক, যিনি তার লেখা দ্বারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধি তুলে ধরতে সদা উদ্যমী। সৃজিতার লেখার ধারা মূলত সাহিত্য, সমাজ এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন দিককে ঘিরে আবর্তিত হয়, যেখানে তিনি তার গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বিশ্লেষণী দক্ষতার পরিচয় দেন। তাঁর নিবন্ধ ও প্রতিবেদনগুলি পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, যা তার বস্তুনিষ্ঠতা ও সংবেদনশীলতার পরিচয় বহন করে। সৃজিতা তার কর্মজীবনে ক্রমাগত নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে বদ্ধপরিকর, যা তাকে বাংলা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।