সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে সরকারগুলো বিক্ষোভ দমন ও গুজব রোধের নামে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু গবেষণা দেখাচ্ছে, এই পদক্ষেপ কার্যকর নয় বরং দেশের অর্থনীতি ও নাগরিক অধিকারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ৭৪টি দেশে মোট ৯৩১টি ইন্টারনেট শাটডাউন ঘটেছে। এর মধ্যে ভারতে সর্বোচ্চ ১০৬টি শাটডাউন হয়েছে, যার ৮৫টিই জম্মু ও কাশ্মীরে। সরকারগুলো সাধারণত জনশৃঙ্খলা রক্ষা, গুজব প্রতিরোধ বা নির্বাচনের সময় প্রতারণা রোধের যুক্তি দেখিয়ে এই পদক্ষেপ নেয়।
কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, ইন্টারনেট বন্ধের ফলে বিক্ষোভ কমার বদলে বরং বেড়ে যায়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, টানা ৫ দিনের বেশি ইন্টারনেট বন্ধ থাকলে হিংসাত্মক বিক্ষোভের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্টারনেট বন্ধ থাকলে গুজব ও ভুল তথ্য আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, কারণ সঠিক তথ্য যাচাইয়ের উপায় থাকে না।ইন্টারনেট বন্ধের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতিও বিপুল। ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট শাটডাউনের ফলে ৫.৫ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
ইন্টারনেট সোসাইটির সিনিয়র গ্লোবাল অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার দেজি ব্রাইস ওলুকোটুন বলেন, “সরকারগুলো মনে করে ইন্টারনেট বন্ধ করলে অশান্তি কমবে বা মিথ্যা তথ্য ছড়ানো বন্ধ হবে। কিন্তু এর কোনো প্রমাণ নেই। বরং এতে জরুরি পরিস্থিতিতে পুলিশ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজে বাধা সৃষ্টি হয়। লোকজন প্রিয়জনদের নিরাপত্তা সম্পর্কে জানতে পারে না।”
বাংলাদেশেও ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সরকার দেশজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ করেছিল। তৎকালীন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছিলেন, “ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের ভুল তথ্য ছড়ানো কারণেই এগুলো বন্ধ করা হয়েছিল।” কিন্তু গবেষক ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ইন্টারনেট বন্ধ করা গণতান্ত্রিক দেশের জন্য যৌক্তিক সমাধান নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বলেন, “যে সব দেশে রাজতন্ত্র রয়েছে বা গণতন্ত্র সুসংহত নয় সেখানে ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুব সার্ভিলেন্সের মধ্যে রাখা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশে ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে বিক্ষোভ বন্ধ করা যৌক্তিক সমাধান না।”
ইন্টারনেট বন্ধের বিকল্প হিসেবে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন:
১. সরকার ও নাগরিক সমাজের মধ্যে সংলাপ বাড়ানো।
২. গুজব ও মিথ্যা তথ্য মোকাবেলায় ফ্যাক্ট চেকিং ও মিডিয়া লিটারেসি কার্যক্রম জোরদার করা।
৩. সামাজিক মাধ্যমে হেট স্পিচ ও উসকানিমূলক পোস্ট মনিটরিং ও মডারেশন বাড়ানো।
৪. জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করাইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশন (আইএফএফ) মণিপুরে সাম্প্রতিক ইন্টারনেট শাটডাউনের সমালোচনা করে বলেছে, “ইন্টারনেট শাটডাউন মিথ্যা তথ্য বা সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর – এমন কোনো প্রমাণ নেই। বরং অর্থনৈতিক ও পেশাগত কার্যক্রম, সাংবাদিকতা, ই-কমার্স ও স্বাস্থ্যসেবার ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।”
সুপ্রিম কোর্টও অনুরাধা ভাসিন বনাম ভারত সরকার মামলায় রায় দিয়েছে যে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাক স্বাধীনতা ও পেশা নির্বাচনের অধিকার মৌলিক অধিকার এবং সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মায়ানমারে ইন্টারনেট শাটডাউনের ফলে প্রায় ২.৮ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে, যা গত এক দশকের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে পিছিয়ে দিয়েছে। ইন্টারনেট সোসাইটি বলছে, “ইন্টারনেট শাটডাউন সমাজ, অর্থনীতি ও বৈশ্বিক ইন্টারনেট অবকাঠামোর ক্ষতি করে। আমরা সব সরকার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের অনুরোধ করছি এমন নীতি সমর্থন করতে যা ইন্টারনেটকে চালু ও শক্তিশালী রাখে, যাতে শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তোলা যায় এবং মানুষকে সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের সুযোগ দেওয়া যায়।”
সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করা সমস্যার সমাধান নয়, বরং নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে। এর পরিবর্তে সরকার, নাগরিক সমাজ ও টেক কোম্পানিগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টায় মিথ্যা তথ্য ও উসকানি মোকাবেলা করা এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার নিশ্চিত করাই হবে কার্যকর সমাধান।