Humayun Faridi Films Impact on Bengali Literature: বাংলাদেশের নাট্য ও চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদি। তাঁর অসাধারণ প্রতিভা ও অভিনয় নৈপুণ্য শুধু দর্শকদের মুগ্ধই করেনি, বাংলা সাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করেছে। আজ আমরা জানব, কীভাবে এই মহান শিল্পী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
হুমায়ূন ফরীদির জীবন ও কর্মের প্রতি একটি দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই যে, তিনি শুধু একজন অভিনেতাই ছিলেন না, বরং একজন সাহিত্য সৃষ্টিকারীও ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২৯ মে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করা এই প্রতিভাবান ব্যক্তি তাঁর জীবনের প্রথম দিকে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করলেও, পরবর্তীতে নাট্যকলার প্রতি আকৃষ্ট হন।
১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত নাট্য উৎসবের মাধ্যমে তিনি নাট্যাঙ্গনে প্রবেশ করেন। এই সময় থেকেই তিনি বিশিষ্ট নাট্যকার সেলিম আল দীনের সাথে ঘনিষ্ঠ হন, যা তাঁর পরবর্তী জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
হুমায়ূন ফরীদির সাহিত্যিক অবদান মূলত নাটক ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি অভিনীত চরিত্রগুলোকে এমনভাবে জীবন্ত করে তুলতেন যে, সেগুলো সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যেত। তাঁর অভিনীত ‘কান কাটা রমজান’ চরিত্রটি বাংলাদেশের টেলিভিশন ইতিহাসে একটি অমর সৃষ্টি।
কলমের যোদ্ধা: হুমায়ুন আজাদের সাহসী লেখনী যেভাবে নাড়া দিয়েছিল বাংলা সাহিত্যকে
১৯৮২ সালে ‘নীল নক্ষত্রের সন্ধানে’ নাটকের মাধ্যমে তিনি টেলিভিশন পর্দায় আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর থেকে তিনি একের পর এক জনপ্রিয় নাটকে অভিনয় করে যান। ‘ভাঙ্গনের শব্দ শুনি’, ‘সংসপ্তক’, ‘পথের সময়’, ‘দুই ভাই’, ‘শীতের পাখি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘সমুদ্রের গাঙচিল’ – এসব নাটকে তাঁর অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছে।
হুমায়ূন ফরীদির সবচেয়ে বড় অবদান হল তিনি বাংলা সাহিত্যের চরিত্রগুলোকে জীবন্ত করে তোলার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে সাহিত্যকে সহজলভ্য করে তুলেছেন। তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলো এতটাই প্রাণবন্ত ছিল যে, সেগুলো আজও মানুষের মনে গভীরভাবে গেঁথে আছে।
চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয়ও ছিল অনন্য। ১৯৮৪ সালে ‘হুলিয়া’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি বড় পর্দায় আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর ‘মাতৃত্ব’, ‘বহুব্রীহি’, ‘আহা!’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’ সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ২০০৪ সালে ‘মাতৃত্ব’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
শব্দের জাদুকর: নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতায় বাঙালি জীবনের প্রতিচ্ছবি
হুমায়ূন ফরীদি শুধু অভিনয়ই করেননি, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার ও পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগে অতিথি শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলা নাট্যকলার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
তাঁর সহকর্মী ও বন্ধু পরিচালক শায়ের খান তাঁকে ‘পাগলা’ ও ‘জিনিয়াস’ আখ্যা দিয়েছিলেন। শায়ের খান লিখেছিলেন, “হুমায়ূন ফরীদি এক বিরল প্রতিভার অধিকারী অভিনেতা। যেমন হলিউড এখনো পর্যন্ত পরবর্তী গ্রেগরি পেকের খোঁজ করছে, তেমনি আমাদেরও পরবর্তী ফরীদির জন্য ১০০ বছর অপেক্ষা করতে হবে।” তিনি হুমায়ূন ফরীদিকে ‘বাংলাদেশের গ্রেগরি পেক’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
হুমায়ূন ফরীদির জীবনাবসান ঘটে ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো আজও বাঙালি দর্শকের মনে জীবন্ত। তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৮ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়।
হুমায়ূন ফরীদির মৃত্যুর পর বাংলা সাহিত্য ও নাট্যজগতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণ করা সহজ নয়। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো আজও নতুন প্রজন্মের অভিনেতাদের অনুপ্রেরণা জোগায়। তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা নিয়ে আজও অনেক তরুণ অভিনেতা নিজেদের গড়ে তুলছেন।
হুমায়ূন ফরীদির উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র: বাংলা সাহিত্যে বিশেষ ভূমিকা
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতের অন্যতম কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদি। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রগুলো শুধু বিনোদনের জন্যই নয়, বরং বাংলা সাহিত্যের বিশেষ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই প্রতিবেদনে আমরা হুমায়ূন ফরীদির এমন কিছু উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করব, যা বাংলা সাহিত্যে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
শ্যামল ছায়া (২০০৪)
শ্যামল ছায়া একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র যা হুমায়ূন আহমেদের লেখা ও পরিচালনায় নির্মিত। এই চলচ্চিত্রে হুমায়ূন ফরীদি একজন মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি নৌকায় যাত্রীদের যাত্রা নিয়ে গড়ে উঠেছে। হুমায়ূন ফরীদির অভিনয় চলচ্চিত্রটির গভীরতা ও গুরুত্ব বাড়িয়েছে এবং এটি বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
জয়যাত্রা (২০০৪)
জয়যাত্রা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি চলচ্চিত্র, যা তৌকির আহমেদের পরিচালনায় নির্মিত। এই চলচ্চিত্রে হুমায়ূন ফরীদি একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটি মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও সংগ্রামের কাহিনী তুলে ধরে। ফরীদির অভিনয় চলচ্চিত্রটির মান ও গুরুত্ব বাড়িয়েছে এবং এটি বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
মাতৃত্ব (২০০৪)
মাতৃত্ব চলচ্চিত্রে হুমায়ূন ফরীদি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন এবং তাঁর এই অভিনয়ের জন্য তিনি বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। চলচ্চিত্রটি মায়ের ভালোবাসা ও ত্যাগের কাহিনী নিয়ে গড়ে উঠেছে। ফরীদির অভিনয় চলচ্চিত্রটির গভীরতা ও আবেগ বৃদ্ধি করেছে, যা বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
Tollywood: উত্তম-যুগের পর বাংলা চলচ্চিত্রের নবজাগরণের রূপকার রঞ্জিত মল্লিক
পালাবি কোথায় (১৯৯৭)
পালাবি কোথায় একটি নারীবাদী কমেডি চলচ্চিত্র, যা শাহিদুল ইসলাম খোকনের পরিচালনায় নির্মিত। এই চলচ্চিত্রে হুমায়ূন ফরীদি একজন যৌন হয়রানির শিকার নারীদের সহায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটি নারীদের অধিকার ও সংগ্রামের কাহিনী তুলে ধরে, যা বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
হুলিয়া (১৯৯০)
হুলিয়া চলচ্চিত্রে হুমায়ূন ফরীদি একজন নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করেন। এই চলচ্চিত্রটি বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়, কারণ এটি সমাজের অসঙ্গতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কাহিনী তুলে ধরে।
সংগ্রাম (১৯৯৪)
সংগ্রাম চলচ্চিত্রে হুমায়ূন ফরীদি একজন মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটি মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও সংগ্রামের কাহিনী তুলে ধরে। ফরীদির অভিনয় চলচ্চিত্রটির মান ও গুরুত্ব বাড়িয়েছে এবং এটি বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
হুমায়ূন ফরীদি তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলো সাহিত্যের অমর সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত হয় এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো আজও বাঙালি দর্শকের মনে জীবন্ত এবং নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
হুমায়ূন ফরীদির পুরস্কার সমূহ
হুমায়ূন ফরীদির প্রধান পুরস্কারসমূহ:
১. জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার:
২০০৪ সালে “মাতৃত্ব” চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
২. একুশে পদক:
২০১৮ সালে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়।এছাড়াও তিনি তাঁর অসাধারণ অভিনয় দক্ষতার জন্য বিভিন্ন সময়ে স্বীকৃতি ও সম্মাননা লাভ করেছেন। তবে উপরোক্ত দুটি পুরস্কারই তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জাতীয় পুরস্কার।