Barisal B.M College Controversy: বরিশাল সরকারি বি.এম. কলেজের ক্যাম্পাসে অবস্থিত ‘জীবনানন্দ চত্বর’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ তাহিদুল চত্বর’ রাখা হয়েছে। গত ১৬ আগস্ট বৃহস্পতিবার রাতে কলেজের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। তাঁরা ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে এই ঘোষণা করেন এবং চত্বরের নামফলক পরিবর্তন করে নতুন নামফলক স্থাপন করেন।
এই ঘটনা নিয়ে বরিশাল শহরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। কবি জীবনানন্দ দাশের নাম মুছে ফেলার সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে সাহিত্য ও সংস্কৃতি মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকেই এই সিদ্ধান্তকে বাংলা সাহিত্যের প্রতি অবমাননাকর বলে মনে করছেন।জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) বরিশালের সন্তান এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি বরিশাল ব্রজমোহন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন এবং পরবর্তীতে বরিশাল বি.এম. কলেজে অধ্যয়ন করেন। তাঁর জীবন ও কর্মের সঙ্গে বরিশাল শহরের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
শব্দের জাদুকর: নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতায় বাঙালি জীবনের প্রতিচ্ছবি
বরিশালের কীর্তনখোলা নদী, বেলস পার্ক, এবং শহরতলির প্রকৃতি জীবনানন্দের কবিতায় বারবার এসেছে। তিনি তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বনলতা সেন’-এ লিখেছেন: “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে”। এই পংক্তিগুলি বরিশালের নৌপথের স্মৃতি বহন করে। বি.এম. কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে জীবনানন্দের নাম কলেজের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই তাঁর নামাঙ্কিত চত্বরের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত অনেককেই ব্যথিত করেছে।
অন্যদিকে, যাঁরা নাম পরিবর্তনের পক্ষে, তাঁদের যুক্তি হলো শহীদ তাহিদুল ইসলাম ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া বি.এম. কলেজের একজন ছাত্র ছিলেন। তাঁর স্মৃতিকে সম্মান জানাতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে তাঁরা দাবি করেছেন।এই ঘটনা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি উদযাপনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেছে। একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের বীরদের স্মরণ করা প্রয়োজন, অন্যদিকে বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সাহিত্যিকদের স্মৃতিও সংরক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
জীবনানন্দ দাশের জীবন ও কর্ম বরিশাল শহরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। তিনি ১৮৯৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মযাজক এবং মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন কবি ও গায়িকা। বরিশালের প্রকৃতি ও পরিবেশ জীবনানন্দের কবিতায় গভীর ছাপ ফেলেছিল।জীবনানন্দ বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং ১৯১৫ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপর তিনি বরিশাল বি.এম. কলেজে ভর্তি হন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
জীবনানন্দের কবিতায় বরিশালের প্রকৃতি, বিশেষ করে কীর্তনখোলা নদী বারবার এসেছে। তিনি এই নদীকে ‘ধানসিঁড়ি নদী’ নামে অভিহিত করেছেন। বরিশালের বেলস পার্কও তাঁর কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে। প্রতিদিন বিকেলে তিনি এই পার্কে হাঁটতে যেতেন এবং কীর্তনখোলা নদী ও আশপাশের প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতেন।জীবনানন্দের কবিতায় বরিশালের হেমন্তের দৃশ্য, শস্যহীন মাঠ, বাঁকা চাঁদ – এসব প্রাকৃতিক দৃশ্য বারবার এসেছে। তাঁর কবিতায় বাংলার গ্রামীণ প্রকৃতির যে চিত্র পাওয়া যায়, তার অধিকাংশই বরিশালের অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত।
বুদ্ধ বাবুর চোখ দিয়ে এবার মায়ের আগমনী দেখবে আরো দুজন
জীবনানন্দ শুধু কবিতাই লেখেননি, তিনি অসংখ্য গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধও রচনা করেছেন। তাঁর অনেক গল্প ও উপন্যাসে বরিশাল থেকে কলকাতা যাতায়াতের বর্ণনা পাওয়া যায়। সেই সময়ের স্টিমার যাত্রার অভিজ্ঞতা, যাত্রীদের দুর্দশা, নদীপথের বর্ণনা – এসব তাঁর লেখায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।জীবনানন্দের জীবনে বরিশালের গুরুত্ব এতটাই ছিল যে, তিনি বারবার এখানে ফিরে আসতেন। তাঁর ডায়েরিতে বরিশাল-কলকাতা যাতায়াতের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। এই যাতায়াতের অভিজ্ঞতা তাঁর সাহিত্যকর্মকে সমৃদ্ধ করেছে।
বরিশাল বি.এম. কলেজে জীবনানন্দের নামাঙ্কিত চত্বরের নাম পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ। এটি শুধু একজন মহান কবির প্রতি অবমাননা নয়, বরং বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি একটি আঘাত বলে অনেকে মনে করছেন।অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। তবে একজনের স্মৃতি মুছে ফেলে অন্যজনকে স্মরণ করার এই পদ্ধতি কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।এই ঘটনা থেকে উঠে আসা প্রশ্নগুলি হল:
১. সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি উদযাপনের মধ্যে কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করা যায়?
২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত?
৩. বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন?
এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে, ভবিষ্যতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, সকল পক্ষের মতামত বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। তাহলেই হয়তো আমরা আমাদের অতীতকে সম্মান জানাতে পারব, বর্তমানকে সমৃদ্ধ করতে পারব এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি সুন্দর পথ তৈরি করতে পারব।