রাজস্থানের উদয়পুর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে, আরাবল্লীর মনোরম পাহাড়ের কোলে অবস্থিত ইডানা মাতার (Idana Mata) মন্দির। এটি শুধুমাত্র একটি উপাসনালয় নয়, বরং এক জীবন্ত অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী, যা বছরের পর বছর ধরে ভক্তদের বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করেছে এবং বিজ্ঞানীদের করেছে অবাক। এই মন্দিরের সবচেয়ে বড় খ্যাতি হলো এখানকার দেবীর স্বতঃস্ফূর্ত ‘অগ্নিস্নান’। কোনও বাহ্যিক কারণ ছাড়াই মন্দিরে আগুন জ্বলে ওঠে এবং সেই আগুনে দেবীর श्रृঙ্গার, চুনরি এবং অন্যান্য সামগ্রী ভস্মীভূত হয়ে গেলেও মূল মূর্তিটি সম্পূর্ণ অক্ষত থাকে। এই বিস্ময়কর ঘটনাটিই ইডানা মাতাকে (Idana Mata) বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত করেছে।
স্থানীয়ভাবে ‘মেওয়ালের শক্তিপীঠ’ নামে পরিচিত এই মন্দিরটি শুধু রাজস্থান বা ভারতের নয়, সারা বিশ্বের হিন্দুদের জন্য এক পবিত্র তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। প্রতি মাসে দুই থেকে তিনবার এই অলৌকিক অগ্নিস্নানের ঘটনা ঘটে, যা দেখতে হাজার হাজার ভক্ত ভিড় জমান। তাদের বিশ্বাস, এই অগ্নিস্নান আসলে দেবীর আশীর্বাদ; এই আগুনে তাদের জীবনের সমস্ত দুঃখ, কষ্ট এবং দুর্ভাগ্য পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
মন্দিরের ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনী
ইডানা মাতার মন্দিরের (Idana Mata Temple) ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। যদিও এর প্রতিষ্ঠার সঠিক সময় জানা যায় না, তবে লোককথা অনুসারে, এই স্থানের মাহাত্ম্য মহাভারতের সময়কাল থেকেও প্রচলিত। কথিত আছে, নির্বাসনের সময় পাণ্ডবরা এই স্থানে এসেছিলেন এবং ইডানা মাতার পূজা করেছিলেন।
পরবর্তীকালে, মেওয়ালের শাসকেরাও যুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাওয়ার আগে এই মন্দিরে এসে দেবীর আশীর্বাদ নিতেন। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, জয়সমন্দ হ্রদ নির্মাণের সময় মহারাজা জয় সিং এখানে পূজা দিয়েছিলেন। স্থানীয়দের বিশ্বাস, ইডানা মাতা মেওয়ালের রক্ষাকর্ত্রী এবং এখানকার ৫২টি গ্রামের মানুষের কাছে তিনি পরম আরাধ্যা দেবী।
মন্দিরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো এখানে কোনো ছাদ বা চূড়া নেই। দেবী একটি বড় বটগাছের নিচে খোলা আকাশের নিচে বিরাজমান। ভক্তদের বিশ্বাস, দেবী নিজেই খোলা স্থানে থাকতে পছন্দ করেন এবং বহুবার মন্দির নির্মাণের চেষ্টা করা হলেও তা সফল হয়নি। দেবীর মূর্তির পিছনে রয়েছে হাজার হাজার ত্রিশূল, যা মনস্কামনা পূরণ হওয়ার পর ভক্তরা দেবীকে অর্পণ করেন।
অলৌকিক অগ্নিস্নান: বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু (Agni Snan of Idana Mata)
ইডানা মাতার মন্দিরের (Idana Mata Temple) প্রধান আকর্ষণ হলো এর রহস্যময় অগ্নিস্নান। এই ঘটনাটির কোনো নির্দিষ্ট দিন বা সময় নেই। ভক্তদের মতে, যখন দেবী প্রসন্ন হন, তখনই মন্দিরের গর্ভগৃহে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আগুন জ্বলে ওঠে। আগুনের শিখা ১০ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে দেখা যায়, যা প্রায় ৫ কিলোমিটার দূর থেকেও স্পষ্ট।
এই অগ্নিশিখায় মায়ের পরনের চুনরি, বস্ত্র, श्रृঙ্গার এবং অন্যান্য পূজার সামগ্রী পুড়ে ছাই হয়ে যায়, কিন্তু দেবীর মূর্তিতে সামান্য আঁচড়ও লাগে না। আগুন নিভে যাওয়ার পর মায়ের নতুন করে श्रृঙ্গার করা হয়। একটি প্রতিবেদন অনুসারে, এই ঘটনাটি ভক্তদের কাছে দেবীর সরাসরি আশীর্বাদ গ্রহণের সমান। তারা মনে করেন, এই অগ্নি দর্শনের মাধ্যমে তাদের আত্মা শুদ্ধ হয়।
সাম্প্রতিককালে, ২০২৪ সালের ৯ই এপ্রিল চৈত্র নবরাত্রির প্রথম দিনে এবং ২০২৩ সালের মার্চ মাসেও এই ধরনের অগ্নিস্নানের ঘটনা ঘটেছে, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। এই ঘটনার সাক্ষী হতে দেশ-বিদেশ থেকে বহু মানুষ ছুটে আসেন।
আরোগ্য ও মনস্কামনা পূরণের পীঠস্থান
ইডানা মাতার মন্দির (Idana Mata Temple) শুধু অগ্নিস্নানের জন্যই বিখ্যাত নয়, এটি আরোগ্য লাভের জন্যও পরিচিত। বিশেষ করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত (paralysis) রোগীরা এখানে আরোগ্য লাভের আশায় আসেন। ভক্তদের মধ্যে গভীর বিশ্বাস রয়েছে যে, মায়ের আশীর্বাদে বহু পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন।
এছাড়াও, নিঃসন্তান দম্পতিরা সন্তান লাভের আশায় এখানে এসে দেবীর চরণে দোলনা অর্পণ করেন। মনস্কামনা পূরণ হলে তারা ত্রিশূল এবং ঘণ্টা নিবেদন করে যান। মন্দিরের চারপাশে অসংখ্য ত্রিশূল এই বিশ্বাসের জীবন্ত প্রমাণ।
মন্দিরের কিছু বিশেষত্ব
- পুরোহিতহীন মন্দির: এই মন্দিরের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এখানে কোনো স্থায়ী পুরোহিত নেই। গ্রামের মানুষ পালা করে মায়ের পূজা করেন। মন্দিরের পরিচালনা এবং ভক্তদের সুবিধার জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে।
- খোলা আকাশের নিচে দেবী: দেবী ইডানা মাতা একটি বটগাছের নিচে খোলা চত্বরে পূজিত হন, যা ‘মাতা কা দরবার’ নামে পরিচিত।
- অখণ্ড জ্যোতি: মন্দিরের একপাশে একটি ‘অখণ্ড জ্যোতি’ বা অনন্ত প্রদীপ সর্বক্ষণ জ্বলতে থাকে, যা দেবীর জীবন্ত উপস্থিতির প্রতীক।
- ২৪ ঘণ্টা খোলা: ভক্তদের জন্য মন্দিরের দরজা ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। যে কোনো সময় মানুষ তাদের প্রার্থনা নিয়ে মায়ের কাছে আসতে পারেন।
সমাজে এর প্রভাব
ইডানা মাতার মন্দির (Idana Mata Temple) স্থানীয় অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। পর্যটকদের আনাগোনার ফলে এলাকার পরিবহন, হোটেল এবং অন্যান্য ব্যবসার উন্নতি ঘটেছে।
এছাড়াও, এই মন্দিরটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে একতা ও বিশ্বাসের প্রতীক। ধর্মীয় উৎসবের সময় এখানকার পরিবেশ এক মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়, যেখানে জাত-পাত নির্বিশেষে সকলে মিলে মায়ের আরাধনা করেন।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও সুপারিশ
ইডানা মাতার মন্দিরের (Idana Mata Temple) জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। এর অলৌকিক ঘটনা এবং ভক্তদের বিশ্বাসের কারণে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে মন্দিরের পরিকাঠামোর উন্নয়ন, যেমন – উন্নত রাস্তা, থাকার ব্যবস্থা এবং ভক্তদের জন্য অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হলে, এটি বিশ্বের দরবারে আরও পরিচিতি লাভ করবে। তবে উন্নয়নের পাশাপাশি মন্দিরের পবিত্রতা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করাও অত্যন্ত জরুরি।
উপসংহার
ইডানা মাতার স্বয়ম্ভু মন্দির (Swayambhu Temple of Idana Mata) শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি বিশ্বাস, রহস্য এবং অলৌকিকতার এক অনন্য সংমিশ্রণ। এখানে বিজ্ঞান ও যুক্তির ঊর্ধ্বে গিয়ে বিশ্বাসই প্রধান হয়ে ওঠে। দেবীর অগ্নিস্নান এক এমন বিস্ময়, যা আধুনিক যুগেও মানুষকে ভাবায় এবং ঐশ্বরিক শক্তির প্রতি বিশ্বাসকে আরও মজবুত করে তোলে। যুগ যুগ ধরে এই মন্দিরটি মানুষের আশ্রয়, আরোগ্য এবং শান্তির কেন্দ্র হয়ে রয়েছে।
প্রায়শ জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)
১. ইডানা মাতার মন্দির কিসের জন্য বিখ্যাত?
ইডানা মাতার মন্দির প্রধানত এর অলৌকিক ‘অগ্নিস্নান’ (Agni Snan) ঘটনার জন্য বিখ্যাত। এখানে কোনো বাহ্যিক কারণ ছাড়াই মন্দিরে আগুন জ্বলে ওঠে এবং দেবীর श्रृঙ্গার ও চুনরি পুড়ে গেলেও মূল মূর্তি অক্ষত থাকে।
২. ইডানা মাতার মন্দির কোথায় অবস্থিত?
এই মন্দিরটি ভারতের রাজস্থান রাজ্যের উদয়পুর শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে, আরাবল্লী পর্বতমালার মধ্যে সালুম্বর-বান্সওয়ারা রোডের উপর অবস্থিত।
৩. অগ্নিস্নান কখন হয়?
এর কোনো নির্দিষ্ট সময় বা তারিখ নেই। স্থানীয় বিশ্বাস অনুসারে, দেবী যখন ভক্তদের উপর প্রসন্ন হন, তখনই এই অলৌকিক ঘটনা ঘটে। সাধারণত মাসে দুই থেকে তিনবার এমনটা দেখা যায়।
৪. এই মন্দিরে কি পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের চিকিৎসা হয়?
হ্যাঁ, বহু মানুষের বিশ্বাস যে ইডানা মাতার আশীর্বাদে পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা लकवा ग्रस्त রোগীরা আরোগ্য লাভ করেন। বহু দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আরোগ্য লাভের আশায় এখানে আসেন।
৫. মন্দিরের দেবী কি খোলা আকাশের নিচে থাকেন?
হ্যাঁ, ইডানা মাতার মূর্তি একটি বড় বটগাছের নিচে একটি চত্বরে স্থাপন করা হয়েছে। মন্দিরের উপরে কোনো ছাদ বা চূড়া নেই, যা এই মন্দিরের একটি বিশেষত্ব।