আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (IMF) বিশ্বের অর্থনৈতিক দুর্যোগে দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান। এই বিশ্বব্যাপী সংস্থাটি তার সদস্য দেশগুলো থেকেই অর্থায়ন পায়, যার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় অর্থ যোগানদাতা। আমেরিকা বর্তমানে IMF-এ প্রায় ১৫৫ বিলিয়ন ডলার অর্থ যোগান দিয়েছে, যা তাকে ১৭% ভোটিং পাওয়ার দিয়েছে। সম্প্রতি IMF পাকিস্তানকে ১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে, যা তাদের ৭ বিলিয়ন ডলারের এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (EFF) প্রোগ্রামের অংশ। এখানে একটি আশ্চর্যজনক অর্থনৈতিক চক্র কাজ করে – পাকিস্তান IMF থেকে ঋণ নেয়, আমেরিকা সেই IMF-এর প্রধান অর্থদাতা, আর পাকিস্তান সেই ঋণের অর্থ ব্যবহার করে আমেরিকা থেকে পণ্য ক্রয় করে।
IMF-এর অর্থায়ন কাঠামো: আমেরিকার প্রভাব
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস সম্মেলনে প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে আমেরিকা আয়োজক দেশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মহামন্দার পরে বিশ্ব অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনার উদ্দেশ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়। প্রায় সমস্ত দেশই IMF-এর সদস্য, কিন্তু তাদের প্রভাব সমান নয়।
আমেরিকা IMF-এর সবচেয়ে বড় আর্থিক অবদানকারী, যার মোট যোগান প্রায় ১৫৫ বিলিয়ন ডলার। এই বিপুল অর্থ দুই ভাগে বিভক্ত:
- কোটা বাবদ প্রায় ১১৬ বিলিয়ন ডলার
- নিউ অ্যারেঞ্জমেন্টস টু বরো (NAB) বাবদ প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলার
এই বিশাল অর্থনৈতিক অবদান আমেরিকাকে প্রায় ১৭% ভোটিং পাওয়ার দিয়েছে, যা তাকে বিশেষ ক্ষমতা দেয়। IMF-এর কোনো প্রস্তাব পাস করতে ৮৫% ভোট প্রয়োজন, অর্থাৎ আমেরিকার কাছে কার্যত ভেটো পাওয়ার রয়েছে। কোনো বড় সিদ্ধান্ত আমেরিকার সমর্থন ছাড়া গৃহীত হতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্রের IMF প্রভাবের প্রমাণ:
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা দেখিয়েছে যে, আমেরিকার নিকটতম মিত্র দেশগুলিকে IMF ঋণের ক্ষেত্রে কম শর্ত দেওয়া হয়। বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রম থ্যাকারের আরেকটি গবেষণাও দেখায় যে, যে দেশ আমেরিকার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে (যেমন ভোটিং সাদৃশ্য দ্বারা), সেই দেশ IMF থেকে ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
পাকিস্তান ও IMF: একটি জটিল সম্পর্ক
পাকিস্তানের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে IMF ঋণের উপর নির্ভরশীল। সম্প্রতি ৯ মে, ২০২৫ তারিখে, IMF-এর এক্সিকিউটিভ বোর্ড পাকিস্তানকে ১ বিলিয়ন ডলার প্রদানের অনুমোদন দিয়েছে, যা তাদের ৭ বিলিয়ন ডলারের এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (EFF) প্রোগ্রামের প্রথম পর্যালোচনার অংশ।
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা:
- গত ৩৫ বছরের মধ্যে ২৮ বছর IMF-এর সাহায্য নিয়েছে
- শুধু গত ৫ বছরে ৪টি আলাদা IMF প্রোগ্রাম চালু করেছে
- ২০২৪ সালে পাকিস্তানের বহির্বিশ্বের ঋণ ১৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে
- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ১৫ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে মাত্র তিন মাসের আমদানি খরচ চালানো সম্ভব
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ IMF-এর অনুমোদিত ১ বিলিয়ন ডলার নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এই অর্থ বিতরণের ফলে, ৭ বিলিয়ন ডলারের প্রোগ্রামের অধীনে মোট অর্থ বিতরণ এখন ২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
ভারত ও পাকিস্তান ঋণ বিতর্ক
IMF-এর এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভারত কড়া অবস্থান নিয়েছে। ভারত IMF বোর্ডের মিটিংয়ে ভোটদান থেকে বিরত থেকে “শক্তিশালী মতবিরোধ” নিবন্ধন করেছে। ভারতের উদ্বেগ দুইটি প্রধান বিষয়ে কেন্দ্রীভূত:
- পাকিস্তানের খারাপ ট্র্যাক রেকর্ড: ভারতের মতে, পাকিস্তান বারবার IMF ঋণ নিলেও টেকসই অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
- সন্ত্রাসবাদ অর্থায়নের সম্ভাবনা: ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, এই ঋণ সীমান্ত-পার সন্ত্রাসবাদ অর্থায়নের জন্য ব্যবহার করা হতে পারে।
ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতিতে বলেছে, “সীমান্ত-পার সন্ত্রাসবাদের অব্যাহত পৃষ্ঠপোষকতাকে পুরস্কৃত করা বিপজ্জনক বার্তা প্রেরণ করে। এটি অর্থায়ন সংস্থা এবং দাতাদের সুনাম ঝুঁকিতে ফেলে এবং বৈশ্বিক মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।”
এর প্রতিক্রিয়ায়, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শরীফ বলেছেন যে এটি “ভারতের উচ্চ-হস্তক্ষেপমূলক কৌশলের পরাজয়” এবং পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে আন্তর্জাতিক আস্থার প্রতীক।
অর্থনৈতিক চক্র: IMF, আমেরিকা ও পাকিস্তান
এখানে একটি আশ্চর্যজনক অর্থনৈতিক চক্র কাজ করে, যা আমাদের সাধারণ দৃষ্টিতে প্রায়ই ধরা পড়ে না:
- আমেরিকা IMF-কে অর্থায়ন করে: আমেরিকা IMF-এর প্রধান অর্থদাতা, ১৫৫ বিলিয়ন ডলারের যোগান সহ।
- IMF পাকিস্তানকে ঋণ দেয়: IMF পাকিস্তানকে বিভিন্ন ঋণ প্রোগ্রাম প্রদান করে, সর্বশেষ ৭ বিলিয়ন ডলারের EFF।
- পাকিস্তান আমেরিকার পণ্য ক্রয় করে: পাকিস্তান এই ঋণের অংশ ব্যবহার করে আমেরিকা থেকে সামরিক সরঞ্জাম, খাদ্যশস্য সহ বিভিন্ন পণ্য ক্রয় করে।
- অর্থ আমেরিকায় ফিরে যায়: এভাবে, একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আবার আমেরিকার অর্থনীতিতে ফিরে যায়।
এই চক্রটি দেখায় যে আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ব্যবস্থা যতটা সরল মনে হয়, বাস্তবে ততটা সরল নয়। অর্থনৈতিক সহায়তার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থও এর সাথে জড়িত।
IMF-এর ঋণদান কর্মকাণ্ড ও সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান
IMF-এর সাম্প্রতিক ঋণদান কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য:
- ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত, IMF সাধারণ রিসোর্স অ্যাকাউন্টের অধীনে ২৬.৬ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি অনুমোদন করেছে এবং ১৪.৬ বিলিয়ন ডলার বিতরণ করেছে
- দারিদ্র্য হ্রাস ও প্রবৃদ্ধি ট্রাস্টের অধীনে ১.৯ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি অনুমোদন করেছে এবং ০.৮ বিলিয়ন ডলার বিতরণ করেছে
- রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ট্রাস্টের অধীনে ২.৪ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি অনুমোদন করেছে এবং ০.৭ বিলিয়ন ডলার বিতরণ করেছে
IMF সদস্যপদ ও শাসন কাঠামো
IMF-এর সদস্য দেশগুলি কেবল সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়, বরং বিশেষ এখতিয়ারভুক্ত অঞ্চলও এর অন্তর্ভুক্ত, যেমন আরুবা, কুরাসাও, হংকং, মাকাও এবং কসোভো। সদস্যপদের জন্য দেশগুলিকে:
- কোটা বাবদ নিয়মিত সদস্য পেমেন্ট করতে হয়
- IMF-এর অনুমতি ছাড়া মুদ্রা বিধিনিষেধ থেকে বিরত থাকতে হয়
- IMF-এর আর্টিকেলস অফ এগ্রিমেন্ট-এ কোড অফ কন্ডাক্ট মেনে চলতে হয়
- জাতীয় অর্থনৈতিক তথ্য সরবরাহ করতে হয়
লিখটেনস্টাইন ২১ অক্টোবর, ২০২৪ তারিখে IMF-এর ১৯১তম সদস্য হয়েছে। IMF-এর বাইরে থাকা জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলি হল কিউবা, মোনাকো এবং উত্তর কোরিয়া।
ভোটিং সংস্কার ও বিকাশশীল দেশের প্রতিনিধিত্ব
IMF-এর ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় বিকাশশীল দেশগুলি ভালভাবে প্রতিনিধিত্ব করেনি। উদাহরণস্বরূপ, সবচেয়ে জনবহুল দেশ হওয়া সত্ত্বেও চীনের ভোটের অংশ ছিল ষষ্ঠ বৃহত্তম; ব্রাজিলের ভোটের অংশ ছিল বেলজিয়ামের চেয়ে ছোট।
বিকাশশীল অর্থনীতিগুলিকে আরও ক্ষমতা দেওয়ার জন্য সংস্কারগুলি ২০১০ সালে G20 দ্বারা সম্মত হয়েছিল। তবে, সংস্কারগুলি পাস করতে পারেনি, কারণ এগুলি মার্কিন কংগ্রেস দ্বারা অনুমোদিত হওয়া আবশ্যক ছিল। ফান্ডের ভোটিং পাওয়ারের ৮৫% সংস্কারগুলি কার্যকর করার জন্য প্রয়োজন ছিল, এবং আমেরিকানদের সেই সময়ে ১৬% এরও বেশি ভোটিং পাওয়ার ছিল। বারবার সমালোচনার পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশেষে ২০১৫ সালের শেষে ভোটিং সংস্কারগুলি অনুমোদন করে।
আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের জটিলতা
IMF, আমেরিকা ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ব্যবস্থার জটিলতা তুলে ধরে। এই সম্পর্ক কেবল অর্থনৈতিক সহায়তার ঊর্ধ্বে, রাজনৈতিক প্রভাব ও কৌশলগত স্বার্থের একটি জটিল নেটওয়ার্ক প্রতিফলিত করে।
আমেরিকা যেখানে IMF-এর প্রধান অর্থদাতা হিসেবে এর নীতি ও সিদ্ধান্তগুলিতে প্রভাব বিস্তার করে, সেখানে ঋণগ্রহীতা দেশগুলি যেমন পাকিস্তান, আর্থিক সংকট মোকাবেলায় IMF-এর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই প্রক্রিয়ায়, অর্থ একটি চক্রাকার পথে প্রবাহিত হয় – IMF থেকে ঋণগ্রহীতা দেশে, সেখান থেকে পণ্য ও সেবা ক্রয়ের মাধ্যমে উন্নত অর্থনীতিতে, বিশেষ করে আমেরিকায়।
এই অর্থনৈতিক চক্র বোঝা বিশ্ব অর্থনীতির কার্যপ্রণালী বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি প্রমাণ করে যে আন্তর্জাতিক অর্থায়ন শুধু আর্থিক সহায়তাই নয়, বরং বৈশ্বিক রাজনীতি, কূটনীতি এবং বাণিজ্যের একটি জটিল সমন্বয়।