ভাদু ব্রত কোন মাসে পালিত হয়? জানুন রাঢ়বঙ্গের এই প্রাচীন ব্রতের সম্পূর্ণ ইতিহাস ও নিয়মকানুন

স্টাফ রিপোর্টার 6 Min Read

 Bhadu Brat: বাংলার লোকসংস্কৃতির এক অনন্য ধারা ভাদু ব্রত। রাঢ়বঙ্গের মাটিতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পালিত হয়ে আসছে এই মেয়েলি ব্রত। আপনি কি জানেন ভাদু ব্রত কোন মাসে পালিত হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পাশাপাশি আজকে আমরা জানব এই প্রাচীন ব্রতের ইতিহাস, রীতিনীতি এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্য সম্পর্কে। যুগ যুগ ধরে কুমারী মেয়েদের কাছে পবিত্র এই ব্রতের পেছনে রয়েছে এক মর্মস্পর্শী কাহিনী এবং গভীর সামাজিক অর্থ।

ভাদু ব্রত কোন মাসে পালিত হয়?

ভাদু ব্রত মূলত ভাদ্র মাসে পালিত হয়। বাংলা পঞ্জিকার ভাদ্র মাস হচ্ছে বছরের পঞ্চম মাস, যা ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসের সাথে মিলে যায়। ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকে শুরু করে মাসের শেষ দিন পর্যন্ত এই ব্রত চলতে থাকে।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ভাদ্র মাসের প্রারম্ভেই মেয়েলি ব্রত শুরু হয় এবং ভাদ্র সংক্রান্তির দিনে ভাদু পুজো সম্পন্ন হয়। অর্থাৎ পুরো এক মাস ধরে এই ব্রত পালিত হয়, যা এর গুরুত্ব ও ব্যাপকতার প্রমাণ দেয়।

ভাদু ব্রতের ঐতিহাসিক পটভূমি

কিংবদন্তির সূত্রপাত

ভাদু ব্রতের উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে নানা রোমাঞ্চকর কিংবদন্তি। সবচেয়ে প্রচলিত মতে, পঞ্চকোট জেলার কাশীপুর রাজ্যের ভাদু বা ভদ্রেশ্বরী নামক এক রাজকন্যার কাহিনী থেকে এর উদ্ভব। বাগ্দত্ত এক রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে না হওয়ায় রাজকন্যা ভাদু আত্মহত্যা করেন।

আরেকটি জনপ্রিয় কাহিনী অনুযায়ী, ভাদু ছিলেন কাশীপুরের রাজার মেয়ে। বর্ধমানের রাজকুমারের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু বিয়ে করতে আসার পথে লেঠেলদের হাতে রাজকুমারের মৃত্যু ঘটে। এই শোকে ভাদু আত্মহত্যা করেন।

মা কালীর মূর্তি ঘরে রাখলে কী হয়? জেনে নিন বাস্তুশাস্ত্র অনুযায়ী নিয়ম-কানুন

আদিবাসী সংস্কৃতির প্রভাব

গবেষকদের মতে, ভাদু গানের উৎস খুঁজে পাওয়া যায় আদিবাসী সাঁওতালদের করম গানে। আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, বর্ষা উৎসবের এই করম গানের হিন্দু সংস্করণ হিসেবে ভাদু গানকে ধরা যায়। এটি মূলত একটি উর্বরতার প্রতীক রূপে পালিত লোক উৎসব।

ভাদু ব্রতের রীতিনীতি ও পালন পদ্ধতি

ব্রত শুরুর প্রক্রিয়া

পয়লা ভাদ্রে কুমারী মেয়েরা বাড়ির কোনো কুলুঙ্গি বা ছোট প্রকোষ্ঠ পরিষ্কার করে ভাদু প্রতিষ্ঠা করে আরাধনা শুরু করে। বাড়ির কুলুঙ্গি পরিষ্কার করে গোবর জল দিয়ে নিকিয়ে সেখানে একটি পাত্রে কিছু ফুল, বিভিন্ন গাছের লতা পাতা দিয়ে ভাদুর বিমূর্ত রূপ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

দৈনন্দিন পূজা পদ্ধতি

প্রতিদিন সন্ধ্যায় ফুল ও ফলমূল দিয়ে নিবেদন করা হয়। ভক্তি ভরে প্রণাম করা হয় ভাদুকে। সারা মাস ধরে ভাদু পুজোর বিশেষ রীতি পালন করে মাসের সংক্রান্তিতে ভাদুর বিমূর্ত কাঠামো, উপকরণ বা মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হয়।

ভাদু মূর্তি প্রতিষ্ঠা

ভাদ্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে ভাদু মূর্তি বাড়িতে আনা হয়। বর্তমানে হংস, ময়ূর বা পদ্মের উপর ভাদু মূর্তি গড়ে ওঠে; অভিজাত পরিবারের কুলদেবী লক্ষীর মতো রূপে। যা দেখে মনে হয় মা লক্ষী কুলীন ধনী পরিবারগুলোর সিংহাসন বন্দী না থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যেই বিরাজ করছেন ভাদু নামে।

ভাদু গান ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য

ভাদু গানের বৈশিষ্ট্য

ভাদু উৎসবে “ভাদুর গান” নামে এক বিশেষ ধরনের গান গাওয়া হয়, যা সাধারণত মেয়েরাই গেয়ে থাকে। এই গানগুলি ভাদুর জীবনের কাহিনী বা অন্যান্য লোককাহিনী নিয়ে রচিত হয়। ভাদ্র মাসের প্রথম দিনটিতে ভাদুর আগমনী গান গাওয়া হয়।

আগমনী গানের তাৎপর্য

ভাদুর বিমূর্ত রূপ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরা ভাদুর আগমনী গান গায়। এই গানের মাধ্যমে তারা ভাবী জীবনের স্বপ্নের জাল বোনে। প্রকৃতির সঙ্গে মানব জীবনের এই আত্মিক সঙ্গতির সূত্রেই ভাদু গানের অবাধ বিকাশ হয়েছে।

ভাদু জাগরণ ও বিসর্জন অনুষ্ঠান

জাগরণের বিশেষত্ব

ভাদ্র সংক্রান্তির আগের রাতে ভাদু জাগরণ পালন করা হয়। রঙিন কাগজ বা কাপড়ের তৈরি ঘরে ভাদু মূর্তি স্থাপন করা হয় এবং বিভিন্ন মিষ্টি সাজিয়ে দেওয়া হয় ভোগ হিসেবে। বিশেষত বৃহৎ আকারের জিলিপি এবং গজা প্রয়োজন। জিলিপির আকার ছোট হলে মা ভাদু অভিমান করেন বলে সবাই মনে করে।

বিসর্জনের আবেগময় মুহূর্ত

‘ভাদু ভাসান’ পর্ব অত্যন্ত বিষাদময়। ভাদ্র সংক্রান্তিতে উপাসকরা মূর্তিসহ নদীর তীরে সমবেত হয়ে মূর্তি বিসর্জন দেয়। ভাদ্র সংক্রান্তির দিন সকাল থেকে বিকেলের মধ্যে ভাদু মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হয় এবং অপেক্ষা করা হয় পরের বছরের।

ভৌগোলিক বিস্তৃতি ও আঞ্চলিক প্রভাব

ভাদু ব্রত প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এবং লাগোয়া বিহার, ঝাড়খণ্ডের দু-একটা জেলায় প্রচলিত। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এই উৎসব বিশেষভাবে পালিত হয়।

ভাদু ব্রতের ধর্মীয় ও সামাজিক তাৎপর্য

কৃষি সংস্কৃতির সাথে সম্পর্ক

ভাদু মূলত একটি কৃষি উৎসব। একদল গবেষক বলেন, ভাদু আদপে শস্যদেবী। মাঠের ধান ওঠার পর চাষিদের ঘরে ঘরে শস্য বন্দনার রেওয়াজই নানা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ভাদু পরবে পরিণত হয়েছে।

নারীশক্তির প্রতীক

ভাদু উৎসব গ্রামীণ জীবনে আনন্দ ও উৎসবের বার্তা নিয়ে আসে এবং এটি নারীকেন্দ্রিক একটি উৎসব। সংক্ষেপে, ভাদু উৎসব গ্রামীণ জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এটি নারীশক্তির প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হয়।

প্রদোষ ব্রত: পালনের নিয়ম, সময়সূচী এবং তাৎপর্য

আধুনিক যুগে ভাদু ব্রতের প্রাসঙ্গিকতা

আজকের যুগেও ভাদু ব্রত তার আদি রূপ ও মাহাত্ম্য বজায় রেখেছে। শহুরে জীবনযাত্রার ব্যস্ততার মাঝেও এই ব্রত পালনের মাধ্যমে মানুষ তাদের শেকড়ের সাথে যুক্ত থাকার চেষ্টা করে। বিশেষত কুমারী মেয়েদের কাছে এই ব্রত শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং সামাজিক বন্ধন ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

ভাদু গানের মাধ্যমে আজও মেয়েরা তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ও ভবিষ্যতের কামনা প্রকাশ করে থাকে। এই গানগুলি শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং জীবনের গভীর অনুভূতির প্রকাশ।

পরিশেষে, ভাদু ব্রত শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি বাংলার সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতির একটি অমূল্য ঐতিহ্য। ভাদ্র মাসে পালিত এই ব্রত আমাদের পূর্বপুরুষদের গভীর বিশ্বাস, সামাজিক মূল্যবোধ এবং প্রাকৃতিক জীবনযাত্রার সাথে সংযোগের প্রমাণ বহন করে। আপনিও যদি এই সুন্দর ঐতিহ্যের অংশীদার হতে চান, তাহলে আগামী ভাদ্র মাসে এই ব্রত পালনে অংশগ্রহণ করুন। এই পোস্টটি ভালো লাগলে অন্যদের সাথে শেয়ার করুন এবং মন্তব্যে জানান আপনার অভিজ্ঞতার কথা।

Share This Article