quitting smoking benefits: ধূমপান ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। আশ্চর্যজনক বিষয় হল, সিগারেটের শেষ টানটি নেওয়ার মাত্র কয়েক মিনিট পরেই আপনার শরীর নিজেকে সুস্থ করার প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। ধূমপান ছাড়ার প্রথম ২৪ ঘন্টার মধ্যেই হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা উন্নত হওয়া থেকে শুরু করে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধি পর্যন্ত নানা ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। এই লেখায় আমরা বিস্তারিতভাবে জানব যে ধূমপান ছাড়ার পর প্রথম দিনেই আপনার শরীরে কী কী উপকারী পরিবর্তন ঘটে।
২০ মিনিটের মধ্যে হৃদযন্ত্রের উন্নতি
শেষ সিগারেট খাওয়ার মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যেই আপনার শরীরে প্রথম ইতিবাচক পরিবর্তনটি ঘটে। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই হৃদস্পন্দন এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রায় নেমে আসতে শুরু করে। নিকোটিন রক্তনালীর ভেতরের দেয়ালের ক্ষতি করে এবং হৃদযন্ত্রে অক্সিজেনের সরবরাহ কমিয়ে দেয়, যার ফলে হৃদযন্ত্রকে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত স্পন্দিত হতে হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত রক্তনালীগুলোকে অধিক পরিশ্রম করতে হয়।
ধূমপানকারীদের হৃদযন্ত্রের উপর যে চাপ পড়ে, তা থেকে মুক্তি পেতে শুরু করে এই সংক্ষিপ্ত সময়েই। উচ্চ রক্তচাপ “নীরব ঘাতক” নামে পরিচিত কারণ এর বিপজ্জনক প্রভাবগুলো প্রায়শই কোনো লক্ষণ ছাড়াই দেখা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস এবং আরও অনেক গুরুতর সমস্যা।
২ ঘন্টায় রক্ত সঞ্চালনের উন্নতি
ধূমপান ছাড়ার দুই ঘন্টার মধ্যে আপনার পেরিফেরাল রক্ত সঞ্চালনে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। পেরিফেরাল শিরা এবং ধমনীগুলো হাত, পা, পায়ের পাতা এবং হাতের তালুতে অবস্থিত থাকে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন সরবরাহ করে। সিগারেটের রাসায়নিক পদার্থ থেকে শরীর মুক্ত হওয়ার সাথে সাথে আপনার হাত ও পা উষ্ণ অনুভব করতে শুরু করবে।
এই পরিবর্তনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভালো রক্ত সঞ্চালন স্বাস্থ্যকর রক্তচাপ, স্পন্দন এবং রক্তে অক্সিজেনের মাত্রার সাথে সরাসরি যুক্ত। উন্নত রক্ত সঞ্চালনের ফলে শরীরের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পর্যাপ্ত পুষ্টি এবং অক্সিজেন পেতে শুরু করে।
১২ ঘন্টায় কার্বন মনোক্সাইডের মাত্রা হ্রাস
ধূমপান ছাড়ার প্রায় ১২ ঘন্টা পর রক্তে কার্বন মনোক্সাইডের মাত্রা স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসে। কার্বন মনোক্সাইড একটি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ যা গাড়ির নিঃসরণ থেকে যে ধোঁয়া বের হয় তার মতোই ক্ষতিকর। এই গ্যাস রক্তকোষে অক্সিজেনের স্থান দখল করে নেয়, যার ফলে হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছায় না।
ধূমপানকারীদের রক্তে কার্বন মনোক্সাইডের মাত্রা যারা ধূমপান করেন না তাদের তুলনায় ৩ থেকে ১৫ গুণ বেশি থাকে। উচ্চ মাত্রায় কার্বন মনোক্সাইড মাথাব্যথা, দ্রুত হৃদস্পন্দন, মাথা ঘোরা বা বমি বমি ভাব সৃষ্টি করতে পারে। এই মাত্রা স্বাভাবিক হয়ে আসার ফলে লোহিত রক্তকণিকায় অধিক অক্সিজেনের জায়গা তৈরি হয়।
২৪ ঘন্টায় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি হ্রাস
ধূমপান ছাড়ার মাত্র একদিনের মধ্যেই রক্তে নিকোটিনের মাত্রা নগণ্য পর্যায়ে নেমে আসে। এই সময়ের মধ্যে শিরা ও ধমনীর সংকোচন কমে যায় এবং হৃদযন্ত্রে অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা উন্নত হয় এবং হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
ধূমপান হার্ট অ্যাটাকের প্রধান কারণ। গবেষণা অনুযায়ী, ধূমপানকারীদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ৭০% বেশি থাকে। ধূমপান রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বাড়ায়, যা হার্ট অ্যাটাকের আরেকটি প্রধান কারণ। যারা ইতিমধ্যে হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়েছেন এবং পরবর্তীতে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন, তাদের পুনরায় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ৫০% কমে যায়।
শ্বাসযন্ত্রের প্রাথমিক উন্নতি
প্রথম ২৪ ঘন্টায় শ্বাসযন্ত্রেও কিছু প্রাথমিক উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। ব্রঙ্কিয়াল টিউবগুলোতে যে প্রদাহ থাকে তা কমতে শুরু করে। সিগারেটের ধোঁয়া এই শ্বাসনালীগুলোতে প্রদাহ সৃষ্টি করে, যার ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কিন্তু ধূমপান বন্ধ করার ৭২ ঘন্টার মধ্যেই এই নালীগুলো শিথিল হতে শুরু করে এবং বাতাস চলাচলের পথ আরো প্রশস্ত হয়।
ফুসফুসের ক্ষুদ্র পশমের মতো গঠন যাদের সিলিয়া বলা হয়, সেগুলোও এই সময়ে নিজেদের কার্যকারিতা ফিরে পেতে শুরু করে। এই সিলিয়াগুলো ফুসফুস পরিষ্কার রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এরা কফ এবং ধূলাবালি বাইরে বের করে দেয়।
অক্সিজেন সরবরাহে উন্নতি
ধূমপান ছাড়ার ফলে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসতে শুরু করে। কার্বন মনোক্সাইড অপসারণের ফলে লোহিত রক্তকণিকায় অক্সিজেন বহনের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছাতে শুরু করে।
বর্ধিত অক্সিজেন সরবরাহের ফলে শারীরিক কার্যকলাপ এবং ব্যায়াম করা আগের তুলনায় সহজ হয়ে ওঠে। অনেকে এই সময়ে শক্তির মাত্রায় উন্নতি অনুভব করতে শুরু করেন।
মানসিক এবং শারীরিক সুবিধা
ধূমপান ছাড়ার প্রথম দিনেই অনেকে মানসিক পরিবর্তনও অনুভব করেন। যদিও নিকোটিন প্রত্যাহারের কারণে কিছু অস্বস্তি থাকতে পারে, তবুও অনেকে আত্মবিশ্বাস এবং নিয়ন্ত্রণের অনুভূতি পান। গবেষণায় দেখা গেছে যে ৯০% জরিপে অংশগ্রহণকারী ধূমপান ছাড়ার পর কম মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা বিষণ্নতা অনুভব করেছেন।
শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণও এই সময়ে উন্নত হতে শুরু করে। ধূমপানের কারণে রক্ত সঞ্চালনে যে বাধা সৃষ্টি হয়, তা দূর হওয়ার ফলে হাত ও পায়ের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ফিরে আসে।
দীর্ঘমেয়াদী সুবিধার শুরু
যদিও ২৪ ঘন্টা একটি সংক্ষিপ্ত সময়, তবুও এই সময়ের মধ্যে যে পরিবর্তনগুলো ঘটে সেগুলো দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সুবিধার ভিত্তি তৈরি করে। এক বছর ধূমপান ছেড়ে থাকার পর হৃদরোগের ঝুঁকি অর্ধেক কমে যায়। পাঁচ বছর পর স্ট্রোকের ঝুঁকি অধূমপায়ীদের সমান হয়ে যায়। দশ বছর পর ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি অর্ধেক কমে যায়।
তিরিশ বছর বয়সে ধূমপান ছাড়লে প্রায় ১০ বছর বেশি বাঁচার সম্ভাবনা থাকে। এমনকি চল্লিশ বছর বয়সেও ধূমপান ছাড়লে ৯ বছর, পঞ্চাশ বছর বয়সে ৬ বছর এবং ষাট বছর বয়সেও ৩ বছর বেশি বাঁচার সম্ভাবনা রয়েছে।
সফল ধূমপান ত্যাগের পরামর্শ
ধূমপান ছাড়ার প্রথম ২৪ ঘন্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে নিকোটিন প্রত্যাহারের লক্ষণগুলো তীব্র হতে পারে। এ সময় প্রচুর পানি পান করুন, হালকা ব্যায়াম করুন এবং ধূমপানের বিকল্প হিসেবে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলুন।
পরিবার ও বন্ধুদের সহায়তা নিন। তাদের জানান যে আপনি ধূমপান ছাড়ার চেষ্টা করছেন। তারা আপনাকে উৎসাহ দিতে এবং কঠিন মুহূর্তগুলোতে পাশে থাকতে পারবেন।
ধূমপান ছাড়ার পর প্রথম সপ্তাহটি অতিক্রম করতে পারলে সফলতার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। মনে রাখবেন, প্রতিটি চেষ্টা আপনাকে সফলতার কাছাকাছি নিয়ে যায়।
ধূমপান ছাড়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে শরীরে যে আশ্চর্যজনক পরিবর্তনগুলো ঘটে, তা প্রমাণ করে যে আমাদের শরীরের নিজেকে সুস্থ করার ক্ষমতা কতটা অবিশ্বাস্য। হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক হওয়া থেকে শুরু করে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমা পর্যন্ত – এই সব উপকারিতা পাওয়ার জন্য আপনাকে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হবে না। আজই ধূমপান ছেড়ে দিন এবং আপনার শরীরকে সুস্থতার পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করুন।