চার দিনের তীব্র সংঘর্ষের পর শনিবার সন্ধ্যা ৫টার সময় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি ‘পূর্ণ ও তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি’ কার্যকর হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর প্রথম ঘোষণা করেন তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে। পাকিস্তানের ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশনস (DGMO) শনিবার বিকাল ৩:৩৫ মিনিটে তার ভারতীয় সমকক্ষকে ফোন করে এই সমঝোতায় পৌঁছান। দুই দেশই স্থল, জল ও আকাশপথে সমস্ত সামরিক কার্যক্রম বন্ধ করতে সম্মত হয়েছে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ
ভারতীয় সূত্র জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি “সরাসরি দুই দেশের মধ্যে” আলোচনার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্র এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে জানিয়েছেন, “ভারত ও পাকিস্তানের ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশনস (DGMOs) সম্মত হয়েছেন যে উভয় পক্ষই সন্ধ্যা ৫টা থেকে স্থল, আকাশ ও সমুদ্রে সমস্ত গোলাগুলি এবং সামরিক কার্যক্রম বন্ধ করবে।”
মিশ্র আরও যোগ করেন, “এই সমঝোতা কার্যকর করার জন্য উভয় পক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশনস আবার মে ১২ তারিখে দুপুর ১২টায় কথা বলবেন।”
যুদ্ধবিরতি চুক্তি ঘোষণার পরও, ভারত সরকার জানিয়েছে যে তারা “সম্পূর্ণ প্রস্তুত” এবং “সর্বদা সতর্ক” রয়েছে। পাকিস্তান থেকে কোনও ভবিষ্যৎ উত্তেজনা “নির্ণায়ক প্রতিক্রিয়া” আহ্বান করবে বলে সতর্ক করা হয়েছে। ভারতের বিবৃতি অনুসারে, পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধবিরতি শর্তসাপেক্ষ এবং প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ব্যবস্থায় ভারতের অবস্থানের কোনও পরিবর্তন নেই, যার মধ্যে সিন্ধু জল চুক্তির স্থগিতাদেশও অন্তর্ভুক্ত।
ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের পটভূমি
বর্তমান সংঘর্ষের সূচনা হয় ২২ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে জম্মু-কাশ্মীরের পাহালগামে ২৬ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করার পর। এই হামলার জন্য ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করেছিল, যা ইসলামাবাদ অস্বীকার করেছে।
প্রতিক্রিয়া হিসাবে, ভারত ৭ মে ‘অপারেশন সিন্দুর’ নামে একটি প্রতিআক্রমণ শুরু করে, যেখানে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে (PoK) ৯টি সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে আক্রমণ করা হয়। পাকিস্তান পাল্টা ড্রোন ও মিসাইল হামলা চালায়, যা জম্মু-কাশ্মীর, পাঞ্জাব, রাজস্থান এবং গুজরাটের অঞ্চলগুলিকে লক্ষ্য করে। ভারতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সফলভাবে এই হুমকিগুলি বাধা দেয়, যা কোনও জীবনহানি বা সম্পত্তির ক্ষতি রোধ করে।
পাকিস্তান থেকে আরও আক্রমণ হয়েছিল, যেখানে ২৬টি সামরিক স্থাপনা এবং বেসামরিক অবকাঠামোকে লক্ষ্য করা হয়েছিল। পরবর্তীতে, ভারত পাকিস্তানের ছয়টি বিমান ঘাঁটি ধ্বংস করে। সংঘর্ষের ফলে উভয় দেশে মোট ৬৬ জন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতা ভূমিকা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শনিবার ওয়াশিংটন ডিসিতে সকাল ৮টার সময় ঘোষণা করেন, “যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় একটি দীর্ঘ রাতের আলোচনার পর, আমি ঘোষণা করতে পেরে আনন্দিত যে ভারত ও পাকিস্তান একটি পূর্ণ ও তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। সাধারণ জ্ঞান এবং বিশাল বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করার জন্য উভয় দেশকে অভিনন্দন।”
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, যিনি সেদিন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির সাথে কথা বলেছিলেন, ট্রাম্পের ঘোষণার সমর্থন করেছেন। রুবিও জানিয়েছেন যে তিনি “ভবিষ্যতের সংঘর্ষ এড়াতে গঠনমূলক আলোচনা শুরু করার জন্য মার্কিন সহায়তা” প্রস্তাব করেছিলেন।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার জিও নিউজে এক সম্প্রচারে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করেছেন, উল্লেখ করেছেন যে সৌদি আরব এবং তুরস্ক চুক্তি মধ্যস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
নিরপেক্ষ ভেন্যুতে ভবিষ্যৎ আলোচনার পরিকল্পনা
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও শনিবার জানিয়েছেন যে ভারত ও পাকিস্তান “একটি নিরপেক্ষ অবস্থানে বিষয়গুলির একটি বিস্তৃত সেটে আলোচনা শুরু করতে” সম্মত হয়েছে। এটি একটি ন্যায্য এবং নিরপেক্ষ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য করা হয়েছে।
এই সমঝোতা বারবার দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক যোগাযোগের পর এসেছে, যার মধ্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ, সেইসাথে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং উভয় পক্ষের সামরিক নেতৃবৃন্দও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
চুক্তি অনুসারে, যুদ্ধবিরতি ১২ মে ২০২৫ সকাল ১২টা পর্যন্ত বহাল থাকবে, যার সময় উভয় দেশের কর্মকর্তারা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করবেন। সি.এন.বি.সি টি.ভি.১৮-এর প্রতিবেদন অনুসারে, পাকিস্তান তার আকাশসীমা সমস্ত বাণিজ্যিক ও সামরিক বিমানের জন্য পুনরায় খুলেছে, যা মে ১০, ২০২৫ তারিখে ভারতীয় সময় অনুযায়ী সন্ধ্যা ৫টা থেকে কার্যকর হয়েছে।
উভয় দেশের নেতৃবৃন্দের প্রতিক্রিয়া
ভারতের প্রতিক্রিয়া:
ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর নিশ্চিত করেছেন যে দুই দেশ “গোলাগুলি ও সামরিক কার্যক্রম বন্ধের বিষয়ে একটি বোঝাপড়া করেছে”। জয়শঙ্কর এক্স (পূর্বের টুইটার) প্ল্যাটফর্মে লিখেছেন, “ভারত ও পাকিস্তান আজ গোলাগুলি ও সামরিক কার্যক্রম বন্ধের বিষয়ে একটি বোঝাপড়া করেছে। ভারত সবসময় সন্ত্রাসবাদের সকল রূপের বিরুদ্ধে দৃঢ় ও আপসহীন অবস্থান বজায় রেখেছে। এটি অব্যাহত থাকবে।”
ভারতের সরকারি সূত্র জানিয়েছে যে যুদ্ধবিরতি তৎক্ষণাৎ কার্যকর হয়েছে, তবে ভারত “সম্পূর্ণ প্রস্তুত” এবং “সর্বদা সতর্ক” রয়েছে। সরকার সতর্ক করেছে যে “যেকোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে যুদ্ধের কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হবে”।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া:
পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এক্সে লিখেছেন, “পাকিস্তান ও ভারত অবিলম্বে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। পাকিস্তান সবসময় অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তার চেষ্টা করেছে, তবে তার সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার সাথে আপোষ করে না!”
পাকিস্তান এয়ারপোর্ট অথরিটি (পিএএ) নিশ্চিত করেছে যে দেশটির আকাশসীমা সমস্ত ধরনের বিমানের জন্য পুনরায় খোলা হয়েছে, যা যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম বাস্তব ফলাফল।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব
যুদ্ধবিরতি ঘোষণাটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে সতর্ক আশাবাদের সাথে গৃহীত হয়েছে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ উভয় দেশকে আরও উত্তেজনা রোধ করতে অর্থপূর্ণ সংলাপে নিযুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
লক্ষণীয়ভাবে, যুদ্ধবিরতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পাকিস্তানকে এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটির অধীনে ১ বিলিয়ন ডলার ছাড় করার অনুমোদন দেওয়ার এক দিন পরে এসেছে। ভারত আগে এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছিল, সতর্ক করে যে তহবিলগুলি সীমান্তপারের কার্যকলাপগুলির জন্য অপব্যবহার করা যেতে পারে।
উভয় পারমাণবিক-সক্ষম দেশের মধ্যে বর্ধিত উত্তেজনার মধ্যে, পারমাণবিক ক্ষমতা সম্পর্কিত উদ্বেগও বৃদ্ধি পেয়েছিল। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ঘোষণা করেছিল যে দেশটির পারমাণবিক অস্ত্রাগার দেখভাল করে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক কমিটি সভা ডেকেছে। তবে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পরবর্তীতে স্পষ্ট করেছেন যে এমন কোন সভার পরিকল্পনা ছিল না।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির তাৎপর্য
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই যুদ্ধবিরতি দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। দুই পরমাণু-সক্ষম দেশের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ বিশ্বব্যাপী গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি প্রদর্শন করে যে আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বিশ্বের সবচেয়ে জটিল দ্বন্দ্বগুলি সমাধান করতে পারে। ভবিষ্যতে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে আলোচনার পরিকল্পনা দুটি দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তির সম্ভাবনা বাড়ায়।
চূড়ান্তভাবে, ভারত ও পাকিস্তানে ‘পূর্ণ ও তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি’ কার্যকর হওয়া এবং সংকট সমাধানে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে আলোচনার পরিকল্পনা দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিকদের জন্য একটি বড় স্বস্তির খবর। তবে, শান্তি বজায় রাখতে উভয় দেশের নেতৃত্বের নিরন্তর প্রয়াস এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সদিচ্ছার ভাবনা থেকে যেন সত্যিকারের, দীর্ঘস্থায়ী শান্তির দিকে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।