শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভারত নতুন ঢাকা সরকারের সাথে কূটনৈতিক সংলাপ স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল স্পষ্ট করে বলেছেন যে, ভারত সরকার ও ভারতের জনগণের কাছে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এই অবস্থানের মধ্য দিয়ে ভারত প্রমাণ করেছে যে তারা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত এবং বাংলাদেশের সাথে বহুমুখী সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে আগ্রহী।
অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের সাথে ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (সিইপিএ) নিয়ে আলোচনার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। ২০২৪ সালে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১১.০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশকে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার করেছে। ভারত যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক পদার্থ এবং খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশে, অন্যদিকে পোশাক, পাট ও চামড়াজাত পণ্য আমদানি করে। সিইপিএ চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বৃদ্ধি: ভারতের কূটনৈতিক চাল
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র যেখানে ভারত বাংলাদেশের সাথে ব্যাপক সহযোগিতা চায়। আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রকল্প, বিভিন্ন সড়ক যোগাযোগ এবং অভ্যন্তরীণ নৌপথ উন্নয়নের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধি করা হচ্ছে5। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতের রপ্তানি ১৭২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে3। ভারত-বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন ও বাণিজ্য প্রোটোকল স্বাক্ষরের মাধ্যমে নদী ও বন্দরের সংযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা একটি জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসিনা সরকারের সময় ২০১৭ সালে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার কাঠামোর উপর একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকীকরণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ভারত ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ সুবিধা প্রদান করেছিল6। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এই ধরনের প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বে আগ্রহ দেখাচ্ছে না এবং এমনকি ২১ মিলিয়ন ডলারের একটি উন্নত সমুদ্রগামী টাগবোট ক্রয়ের চুক্তি বাতিল করেছে।
নদী জল ভাগাভাগি একটি দীর্ঘস্থায়ী বিষয় যা নিয়ে ভারত আলোচনায় আগ্রহী। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি দশকের পর দশক ধরে ঝুলে আছে। গঙ্গা নদী চুক্তি নবায়নের জন্য প্রযুক্তিগত পর্যায়ে আলোচনা শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা পর্যালোচনার জন্য একটি প্রযুক্তিগত দল বাংলাদেশ সফর করবে। যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে ন্যায্য পানি বন্টন নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তী কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
জ্বালানি সহযোগিতা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন নির্মাণসহ যৌথ বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং বিদ্যুৎ বাণিজ্য সম্প্রসারণে ভারত আগ্রহী। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে যৌথ কর্মী দলের মাধ্যমে গ্রিড আন্তঃসংযোগ ও সরবরাহ ত্বরান্বিত করতে হবে।
সাংস্কৃতিক সহযোগিতা ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে ভারত বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। ঢাকায় ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধন দৃঢ় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যোগব্যায়াম, কথক, মণিপুরী নৃত্য, হিন্দি ভাষা এবং হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করছে। ভারত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ১০০০ ‘সুবর্ণ জয়ন্তী বৃত্তি’ ঘোষণা করেছে।
Bangladesh Government: শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বৃদ্ধি: ভারতের কূটনৈতিক চালে কুপোকাত বাংলাদেশ
আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশকে সার্ক, বিমসটেক, বিবিআইএন এবং আইওআরএ কাঠামোর মধ্যে একটি আঞ্চলিক নোঙ্গর হিসেবে দেখতে চায়। ২০১৭ সালে চালু হওয়া জিস্যাট-৯, যা সার্ক স্যাটেলাইট নামেও পরিচিত, টেলিকমিউনিকেশন, দূরশিক্ষা এবং আবহাওয়া সতর্কীকরণ সেবা প্রদান করছে। বিমসটেক উপকূলীয় নৌ-পরিবহন চুক্তির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্র বাণিজ্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং সন্ত্রাসবাদ বিরোধী সহযোগিতায় ভারত আগ্রহী। সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (সিবিএমপি) বাস্তবায়নের ফলে উন্নত টহলদারি এবং সীমান্তে ঘর্ষণ কমানোর যৌথ প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। যৌথ সীমান্ত টহল এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। সীমান্ত এলাকায় নজরদারির জন্য ড্রোনের ব্যবহার পরিস্থিতি পরিবর্তনে সহায়ক হয়েছে।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারতের চ্যালেঞ্জ হলো নতুন সরকারের সাথে কার্যকর সম্পর্ক বজায় রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার চীনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করছে এবং ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগের প্রতি কোনো সংবেদনশীলতা দেখাচ্ছে না। মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন যে বাংলাদেশ ভারতের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য সমুদ্রের একমাত্র রক্ষক হিসেবে চীনা অর্থনীতির সম্প্রসারণ হিসেবে কাজ করতে পারে।
এই জটিল পরিস্থিতিতে ভারতের কূটনীতি হতে হবে সুক্ষ্ম ও দূরদর্শী। বাংলাদেশের জনগণের সাথে আস্থা পুনর্গঠন করা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে একটি কার্যকর সম্পর্ক বজায় রাখা উভয়ই প্রয়োজন। শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের বিষয়ে ভারতের নিষ্ক্রিয়তা বাংলাদেশে ভারত বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি করছে। তবে উভয় দেশের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থে এই সম্পর্ক পুনরুদ্ধার এবং শক্তিশালী করা অপরিহার্য।