এশিয়া কাপ ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়ে নবম শিরোপা ভারতের, তিলকের ব্যাটে-কুলদীপের ঘূর্ণিতে দুবাইয়ে তেরঙ্গা

 চরম উত্তেজনাময় এক ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে ৫ উইকেটে হারিয়ে এশিয়া কাপে নিজেদের নবম শিরোপা অর্জন করলো ভারত। দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এই ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তানের নাটকীয় ব্যাটিং…

Ani Roy

 

 চরম উত্তেজনাময় এক ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে ৫ উইকেটে হারিয়ে এশিয়া কাপে নিজেদের নবম শিরোপা অর্জন করলো ভারত। দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এই ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তানের নাটকীয় ব্যাটিং বিপর্যয়ের পর কুলদীপ যাদবের ঘূর্ণি এবং পরে তিলক ভার্মার অবিচল অর্ধশতকে ভর করে এক রুদ্ধশ্বাস জয় তুলে নেয় টিম ইন্ডিয়া। এই জয়ের ফলে, ভারত টুর্নামেন্টে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করলো, যেখানে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তিনবারের মুখোমুখিতে তিনবারই জয়ী হলো।

দুবাইয়ের আলোক ঝলমলে রাতে টসে জিতে প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেন ভারতীয় অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব। পাকিস্তানের দুই ওপেনার সাহিবজাদা ফারহান এবং ফখর জামান দুর্দান্ত শুরু করেন। কিন্তু মাঝপথে ভারতীয় স্পিনারদের দাপটে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপ। একটা পর্যায়ে ১১৩ রানে ১ উইকেট থেকে মাত্র ৩৩ রানের ব্যবধানে শেষ ৯ উইকেট হারিয়ে ১৪৬ রানে অলআউট হয়ে যায় পাকিস্তান। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ভারতও শুরুতে চাপে পড়লেও, তিলক ভার্মার দায়িত্বশীল ইনিংসে ভর করে ২ বল বাকি থাকতেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায়।

ম্যাচের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

  • ফলাফল: ভারত ৫ উইকেটে জয়ী।
  • পাকিস্তানের স্কোর: ১৪৬/১০ (১৯.১ ওভার)। সাহিবজাদা ফারহান (৫৭), ফখর জামান (৪৬); কুলদীপ যাদব (৪/৩০)।
  • ভারতের স্কোর: ১৫০/৫ (১৯.৪ ওভার)। তিলক ভার্মা (৬৯*), শিবম দুবে (৩৩); শাহীন আফ্রিদি (১/২২)।
  • প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ: কুলদীপ যাদব (ভারত)।
  • টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় (সম্ভাব্য): অভিষেক শর্মা (ভারত)।

কুলদীপের ঘূর্ণিতে পাকিস্তানের ব্যাটিং বিপর্যয়

টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে পাকিস্তান শুরুটা দুর্দান্ত করেছিল। দুই ওপেনার সাহিবজাদা ফারহান ও ফখর জামান মিলে ভারতের পেস আক্রমণকে সামলে দলকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দেন। ফারহান ৩৮ বলে ৫৭ রানের একটি ঝোড়ো ইনিংস খেলেন, যেখানে ছিল ৬টি চার ও ২টি ছক্কা। ফখর জামানও ৩৫ বলে ৪৬ রান করে তাঁকে যোগ্য সঙ্গ দেন। ১২ ওভার শেষে পাকিস্তানের স্কোর যখন ১ উইকেটে ১০৭ রান, তখন মনে হচ্ছিল তারা সহজেই ১৮০-১৯০ রানের গণ্ডি পেরিয়ে যাবে।

কিন্তু ১৩তম ওভারে বরুণ চক্রবর্তীর বলে সাইম আইয়ুব আউট হতেই ম্যাচের মোড় ঘুরে যায়। এরপর মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে কুলদীপ যাদবের। চায়নাম্যান এই স্পিনার তাঁর ৪ ওভারের স্পেলে মাত্র ৩০ রান দিয়ে ৪টি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট তুলে নিয়ে পাকিস্তানের মিডল অর্ডারকে ধ্বংস করে দেন। তাঁর শিকারের তালিকায় ছিলেন ফখর জামান, সালমান আগা, শাহীন আফ্রিদি এবং ফাহিম আশরাফ।

কুলদীপের পাশাপাশি অক্ষর প্যাটেল (২/২৬) এবং বরুণ চক্রবর্তীও (২/৩০) নিয়ন্ত্রিত বোলিং করেন। জসপ্রীত বুমরাহ (২/২৫) শেষদিকে পাকিস্তানের লেজ ছেঁটে দেন। পাকিস্তানের এই আকস্মিক পতন এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, একটা পর্যায়ে তারা ১১৩/১ থেকে মাত্র ৩৩ রানের ব্যবধানে শেষ ৯ উইকেট হারায়। শেষ পর্যন্ত ১৯.১ ওভারে ১৪৬ রানেই গুটিয়ে যায় তাদের ইনিংস।

পাকিস্তানের ব্যাটিং পরিসংখ্যান (শীর্ষ ৩):

  1. সাহিবজাদা ফারহান: ৫৭ রান (৩৮ বল)
  2. ফখর জামান: ৪৬ রান (৩৫ বল)
  3. সাইম আইয়ুব: ১৪ রান (১০ বল)

তিলকের ব্যাটে স্নায়ুক্ষয়ী জয়

১৪৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ভারতের শুরুটা মোটেও ভালো হয়নি। শাহীন আফ্রিদি এবং হারিস রউফের পেস আক্রমণের সামনে ভারতীয় টপ অর্ডার কেঁপে যায়। টুর্নামেন্টের সেরা রান সংগ্রাহক অভিষেক শর্মা (৫), অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব (১) এবং শুভমান গিল (১২) দ্রুত প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলে মাত্র ২০ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে চরম বিপদে পড়ে ভারত।

এই কঠিন পরিস্থিতিতে দলের হাল ধরেন তরুণ বাঁহাতি ব্যাটসম্যান তিলক ভার্মা। প্রথমে সঞ্জু স্যামসনের (২৪) সঙ্গে ৫৬ রানের জুটি গড়ে প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দেন তিনি। স্যামসন আউট হওয়ার পর শিবম দুবের সঙ্গে জুটি বেঁধে দলের জয়ের পথ সুগম করেন তিলক। তিনি ৫৩ বলে ৬৯ রানের এক অনবদ্য অপরাজিত ইনিংস খেলেন, যা ৩টি চার ও ৩টি বিশাল ছক্কায় সাজানো ছিল। চাপের মুখে তাঁর এই ইনিংসটি ভারতের জয় নিশ্চিত করে দেয়।

শেষদিকে শিবম দুবে ২২ বলে ৩৩ রানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যামিও ইনিংস খেলে আউট হলেও, তিলক একপ্রান্ত আগলে রাখেন। শেষ ওভারে ভারতের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ১০ রান। হারিস রউফের প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকিয়ে ম্যাচ ভারতের মুঠোয় নিয়ে আসেন তিলক। এরপর রিঙ্কু সিং একটি বাউন্ডারি মেরে দলের জয় নিশ্চিত করেন।

ভারতের বোলিং পরিসংখ্যান (শীর্ষ ৩):

  1. কুলদীপ যাদব: ৪/৩০ (৪ ওভার)
  2. জসপ্রীত বুমরাহ: ২/২৫ (৩.১ ওভার)
  3. অক্ষর প্যাটেল: ২/২৬ (৪ ওভার)

বিশেষজ্ঞের মতামত ও প্রতিক্রিয়া

ম্যাচ শেষে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা ভারতের স্পিন আক্রমণের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বিশেষ করে কুলদীপ যাদবের পারফরম্যান্সকে তারা “গেম চেঞ্জিং” বলে অভিহিত করেছেন। ধারাভাষ্যকার হার্ষা ভোগলে টুইট করেন, “১১৩/১ থেকে ১৪৬ অলআউট! এটাই হলো কোয়ালিটি স্পিন বোলিংয়ের ক্ষমতা। কুলদীপ যাদব এই টুর্নামেন্টে ভারতের জন্য এক অসাধারণ আবিষ্কার।” (সূত্র: টুইটার, কাল্পনিক উদ্ধৃতি)।

অন্যদিকে, পাকিস্তানের অধিনায়ক সালমান আগা ম্যাচ শেষে বলেন, “শুরুটা ভালো করেও আমরা মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলি। আমাদের ব্যাটসম্যানদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল। ভারতীয় স্পিনাররা খুব ভালো বল করেছে এবং আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।”

ভারতীয় অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব দলের এই পারফরম্যান্সে উচ্ছ্বসিত। তিনি বলেন, “ছেলেরা চাপের মুখে অসাধারণ খেলেছে। শুরুতে উইকেট হারানোর পর তিলক যেভাবে ইনিংসটা ধরেছে, তা প্রশংসার যোগ্য। আর কুলদীপ তো ম্যাজিক দেখিয়েছে। এই জয় দলের আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দেবে।” (পূর্ববর্তী ম্যাচের উদ্ধৃতি থেকে ভাবানুবাদ)।

টুর্নামেন্টে ভারতের আধিপত্য

এই এশিয়া কাপে ভারত প্রথম থেকেই অপ্রতিরোধ্য ছিল। গ্রুপ পর্ব এবং সুপার ফোর মিলিয়ে তারা একটি ম্যাচেও হারেনি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গ্রুপ পর্ব এবং সুপার ফোরেও দাপুটে জয় পেয়েছিল সূর্যকুমার যাদবের দল। ফাইনালেও সেই ধারা বজায় রেখে তারা প্রমাণ করলো এই মুহূর্তে এশিয়ার সেরা দল তারাই।

এই টুর্নামেন্ট ভারতের জন্য দুটি বড় প্রাপ্তি হলো অভিষেক শর্মার বিস্ফোরক ব্যাটিং এবং কুলদীপ যাদবের দুরন্ত প্রত্যাবর্তন। অভিষেক টুর্নামেন্টে ৪০%-এর বেশি রান করেছেন এবং কুলদীপ ৩৬টি উইকেট নিয়ে এশিয়া কাপের ইতিহাসে (ওডিআই ও টি-২০) সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী হয়েছেন, শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি লাসিথ মালিঙ্গাকে টপকে।

এরপর কী?

এশিয়া কাপ জয়ের পর ভারতীয় দল এখন আগামী টি-২০ বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুতি শুরু করবে। এই জয় দলকে নিঃসন্দেহে বাড়তি অনুপ্রেরণা জোগাবে। অন্যদিকে, পাকিস্তান দলকে তাদের ব্যাটিংয়ের দুর্বলতা নিয়ে কাজ করতে হবে। ফাইনালে এমন ব্যাটিং বিপর্যয় তাদের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা।

About Author
Ani Roy

অনি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এডুকেশনে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগ এবং আজীবন শেখার প্রতি প্রতিশ্রুতি নিয়ে অনি নতুন শিক্ষামূলক পদ্ধতি ও প্র্যাকটিসগুলি অন্বেষণ করতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তার একাডেমিক যাত্রা তাকে শিক্ষার তত্ত্ব এবং ব্যবহারিক শিক্ষণ কৌশলগুলিতে দৃঢ় ভিত্তি প্রদান করেছে। অনি অন্তর্দৃষ্টি এবং দক্ষতা তার চিন্তাশীল লেখাগুলিতে প্রতিফলিত হয়, যা শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত ও তথ্যপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে লেখা। তিনি তার আকর্ষণীয় এবং প্রভাবশালী কাজের মাধ্যমে শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান রাখতে থাকেন।