মাত্র দুই বছর আগে যে দেশে ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগানের তীব্র ঝড় বয়ে গিয়েছিল, সেই মালদ্বীপেই আজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে রাষ্ট্রীয় সম্মানে অভ্যর্থনা জানানো হলো। মালদ্বীপের ৬০তম স্বাধীনতা দিবসের প্রধান অতিথি হিসেবে মোদীর এই সফর কেবল একটি আনুষ্ঠানিক সফর নয়, বরং ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্কের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মুইজ নিজেই স্বীকার করেছেন যে, ভারতের ৪,৮৫০ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ তার দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
প্রেসিডেন্ট মুইজের এই রূপান্তর অনেকের কাছেই বিস্ময়ের। ২০২৩ সালে ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইনের নেতৃত্ব দিয়ে ক্ষমতায় আসা এই নেতা এখন ভারতকে ‘বিশ্বস্ত অংশীদার’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা একে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হিসেবে দেখছেন, যেখানে ভারতের ধৈর্যশীল কূটনীতি এবং অর্থনৈতিক সহায়তা কৌশল সফল হয়েছে।
মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে আয়োজিত স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে প্রধানমন্ত্রী মোদী যোগ দেওয়ার পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তি সহযোগিতা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার বিষয়াদি। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো গ্রেটার মালে কানেক্টিভিটি প্রকল্প, যার আওতায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে মালে শহরের সাথে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপের সংযোগ স্থাপন করা হবে।
অথচ এর পেছনের গল্পটি একেবারেই ভিন্ন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মোহাম্মদ মুইজ জয়লাভ করেছিলেন মূলত ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণার জোরে। তার নির্বাচনী ইশতেহারের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সামরিক উপস্থিতি প্রত্যাহার এবং ভারতের প্রভাব কমানো। এই আন্দোলনের মূল কারণ ছিল মালদ্বীপে ভারতের গোয়েন্দা কার্যক্রম এবং চীনের বর্ধিত প্রভাবের বিপরীতে অবস্থান নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা।
তবে ক্ষমতায় আসার পর প্রেসিডেন্ট মুইজের সামনে বাস্তবতার কঠিন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হয়। মালদ্বীপের অর্থনীতি গভীর সংকটে পড়ে। বৈদেশিক মুদ্রার মারাত্মক অভাব, ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা এবং পর্যটন খাতে মন্দা দেশটিকে আর্থিক দুর্দশায় ফেলে দেয়। এই পরিস্থিতিতে চীনের সাহায্য যথেষ্ট ছিল না, অন্যদিকে ভারত তার ধারাবাহিক সহায়তা অব্যাহত রাখে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি ছিল। কিন্তু ২০২৪ সালে মালদ্বীপের আর্থিক সংকট তীব্র হলে ভারত এগিয়ে আসে অভূতপূর্ব সাহায্য নিয়ে। ২০২৪ সালের মে মাসে ভারত স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার মাধ্যমে ৫০ মিলিয়ন ডলারের ট্রেজারি বিল রোলওভার করে এবং অক্টোবরে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের জরুরি আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করে।
এই আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি ভারত ৩,০০০ কোটি টাকার মুদ্রা বিনিময় চুক্তিও সম্পাদন করেছে, যা মালদ্বীপের বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবেলায় সহায়ক হয়েছে। প্রেসিডেন্ট মুইজ স্বীকার করেছেন যে, “ভারত সরকার যে আমাদের ৩০০০ কোটি রুপি আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে এবং তার পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক স্তরে ৪০ কোটি ডলারের কারেন্সি সোয়াপ সমঝোতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার জন্য আমি ভারতের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রেসিডেন্ট মুইজের এই নীতি পরিবর্তনের পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে চীনের সাথে সম্পর্কের জটিলতা। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে চীনে তার রাষ্ট্রীয় সফরে ২০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করলেও, চীনা সহায়তার শর্তাবলী এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে মালদ্বীপে উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের আওতায় ঋণের ফাঁদ এবং কৌশলগত সম্পদের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকি মালদ্বীপের নীতিনির্ধারকদের ভাবিয়ে তোলে।
অপরদিকে, ভারতের সহায়তা ছিল শর্তহীন এবং দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার জন্য ডিজাইন করা। ভারত মালদ্বীপের আবাসন, স্যানিটেশন, পরিচ্ছন্ন শক্তি স্থাপন এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক প্রকল্পে ব্যাপক সহায়তা প্রদান করেছে। বিশেষত গ্রেটার মালে কানেক্টিভিটি প্রকল্প মালদ্বীপের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করবে, যা দেশটির দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
পর্যটন খাতেও ভারতের ভূমিকা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। মালদ্বীপ ২০২৫ সালে ৩ লাখ ভারতীয় পর্যটক আকর্ষণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এটি মালদ্বীপের পর্যটন খাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভারতীয় পর্যটকরা দেশটির অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে। যদিও ২০২৪ সালে ‘ইন্ডিয়া আউট’ আন্দোলনের কারণে ভারতীয় পর্যটকদের সংখ্যা কমে গিয়েছিল, এখন আবার সেই সংখ্যা বৃদ্ধির প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
মালদ্বীপের অর্থনীতিতে ভারতীয় বিপ্লব! জানুন কীভাবে
মালদ্বীপের সাথে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাস অত্যন্ত পুরানো। ১৯৬৫ সালে মালদ্বীপের স্বাধীনতার পর কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকারী প্রথম দেশগুলির মধ্যে ভারত অন্যতম। ২০২৫ সালে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৬০ বছর পূর্ণ হওয়ার এই বিশেষ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী মোদীর মালদ্বীপ সফর বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
এই ছয় দশকে ভারত মালদ্বীপের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে পাশে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সব ধরনের সাহায্য প্রদান করেছে। ১৯৮৮ সালে মালদ্বীপে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সময় ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ এবং ২০০৪ সালের সুনামির পর জরুরি সাহায্য এর উজ্জ্বল উদাহরণ। এই দীর্ঘ সম্পর্কের ভিত্তিতেই বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হচ্ছে।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রেসিডেন্ট মুইজের এই নীতি পরিবর্তন কেবল অর্থনৈতিক প্রয়োজনেই নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত চিন্তাভাবনারও ফসল। মালদ্বীপের মতো ছোট দ্বীপরাষ্ট্রের জন্য বড় শক্তিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনের একাধিপত্যের বিপরীতে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক মালদ্বীপের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সহায়ক।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর এই সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ভারতের ‘নেবারহুড ফার্স্ট’ বা ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির সফল প্রয়োগ। এই নীতির আওতায় ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। মালদ্বীপের ক্ষেত্রে এই নীতি বিশেষভাবে সফল হয়েছে, যেখানে ধৈর্যশীল কূটনীতি এবং অর্থনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে বৈরী মনোভাব থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে রূপান্তর ঘটানো সম্ভব হয়েছে।
আগামী দিনে ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্কের সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা অংশীদারিত্ব’ চুক্তি ভবিষ্যতের সহযোগিতার রূপরেখা নির্ধারণ করেছে। এই চুক্তির আওতায় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যৌথ কার্যক্রম বৃদ্ধি পাবে।
কাপিল দেব: ভারতের একমাত্র ক্রিকেটার যিনি কখনও রান আউট হননি
সামুদ্রিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও দুই দেশের সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান নৌ-উপস্থিতির প্রেক্ষাপটে ভারত-মালদ্বীপ সামুদ্রিক সহযোগিতা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। মালদ্বীপের কৌশলগত অবস্থান ভারত মহাসাগরের প্রধান নৌ-পথগুলো নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই সম্পর্কের উন্নয়ন বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। একদিকে যেখানে চীন তার ‘স্ট্রিং অফ পার্লস’ কৌশলের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে, সেখানে ভারত-মালদ্বীপের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক। এই সম্পর্কের উন্নয়ন অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর জন্যও একটি মডেল হতে পারে।
‘ইন্ডিয়া আউট’ থেকে ‘বিশ্বস্ত অংশীদার’-এ এই রূপান্তর কেবল দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের পরিবর্তন নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ধৈর্য, সহানুভূতি এবং পারস্পরিক সম্মানের শক্তির একটি উদাহরণ। ভারতের এই কূটনৈতিক সাফল্য প্রমাণ করে যে, সামরিক শক্তি বা অর্থনৈতিক চাপের পরিবর্তে সহযোগিতা এবং সহায়তার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী বন্ধুত্ব গড়ে তোলা সম্ভব।