প্রায় তিন বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিধ্বংসী প্রেক্ষাপটে, বিশ্ব যখন একটি स्थायी শান্তি পথের সন্ধানে মরিয়া, ঠিক সেই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আবার উঠে এল ভারত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শীর্ষ নেতৃত্ব প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ ফোনালাপে স্পষ্টতই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এই ভয়াবহ সংঘাতের অবসানে নয়াদিল্লি এক অপরিহার্য ও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে। এই ফোনালাপ কেবল ভারত-ইইউ কৌশলগত সম্পর্ককেই মজবুত করেনি, বরং যুদ্ধ থামাতে ভারতের ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক গুরুত্বকেও বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে।
বৃহস্পতিবার, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটি যৌথ টেলিফোন কলে কথা বলেন ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট আন্তোনিও কস্তা এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনের সঙ্গে। এই আলোচনাতেই ইউরোপীয় নেতৃত্বরা একবাক্যে স্বীকার করেন যে, ইউক্রেনে শান্তি ফেরানোর প্রক্রিয়ায় ভারত একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারে।
ইউরোপের চোখে ভারত: শান্তির পথে এক গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী
উরসুলা ভন ডার লিয়েন, ফোনালাপের পর সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘এক্স’ (পূর্বতন টুইটার)-এ একটি পোস্টে জানান, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে কথা বলে আমরা আনন্দিত। রাশিয়ার আগ্রাসনমূলক যুদ্ধের অবসান ঘটাতে এবং শান্তির পথ তৈরিতে সাহায্য করার জন্য ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।” তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কির সঙ্গে ভারতের ক্রমাগত আলোচনাকে উষ্ণভাবে স্বাগত জানাই।”
এই বার্তাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ভারত ভারসাম্যের কূটনীতি অনুসরণ করেছে। একদিকে যেমন মস্কোর সঙ্গে তার ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, তেমনই অন্যদিকে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার পক্ষেও সওয়াল করেছে। ভারত রাষ্ট্রসংঘের বিভিন্ন প্রস্তাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোটদান থেকে বিরত থাকলেও, প্রধানমন্ত্রী মোদী একাধিকবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে সরাসরি বলেছেন, “এটা যুদ্ধের যুগ নয়” এবং আলাপ-আলোচনা ও কূটনীতির মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করা উচিত।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই latest অবস্থান প্রমাণ করে যে, ভারতের এই নিরপেক্ষ এবং শান্তির পক্ষে থাকা নীতি আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। তারা বুঝতে পারছে যে, মস্কোর উপর প্রভাব রয়েছে এমন হাতে গোনা কয়েকটি দেশের মধ্যে ভারত অন্যতম। তাই নয়াদিল্লির মধ্যস্থতা একটি বাস্তবসম্মত সমাধানের রাস্তা খুলতে পারে।
ফোনালাপের টেবিলে আর কী কী ছিল?
ইউক্রেন সংকট ছাড়াও এই উচ্চ-পর্যায়ের ফোনালাপে ভারত-ইউক্রেন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ভারত-ইইউ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) এবং ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোর (IMEEC)। উভয় পক্ষই এই বিষয়গুলির দ্রুত নিষ্পত্তির উপর জোর দিয়েছে।
- মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA): প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আটকে থাকা এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা ২০২২ সাল থেকে নতুন করে শুরু হয়েছে। উভয় পক্ষই ২০২৫ সালের শেষের মধ্যে এই আলোচনার একটি সফল সমাপ্তি টানতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যদি এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তবে এটি ভারতের জন্য ইউরোপের বিশাল বাজারে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে এবং ইউরোপীয় সংস্থাগুলির জন্য ভারতে বিনিয়োগ ও উৎপাদনের পথ সুগম করবে। বর্তমানে ভারত ও ইইউ-এর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২০২২-২৩ অর্থবর্ষের তথ্য অনুযায়ী), যা এফটিএ স্বাক্ষরিত হলে বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
- ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোর (IMEEC): ২০২৩ সালের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে ঘোষিত এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্পটি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এই করিডোরটি এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং লোহিত সাগরের সাম্প্রতিক অস্থিরতার কারণে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খল যখন বারবার ধাক্কা খাচ্ছে, তখন IMEEC-এর মতো একটি স্থিতিশীল এবং নির্ভরযোগ্য বিকল্প পথের গুরুত্ব অপরিসীম।
যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভারতের অবস্থান
বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধ এক জটিল পর্যায়ে রয়েছে। দীর্ঘ লড়াইয়ে উভয় পক্ষই ক্লান্ত, কিন্তু কেউই পিছু হটতে রাজি নয়। একদিকে ইউক্রেন যেমন পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে, তেমনই রাশিয়াও তার অর্থনীতিকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিয়ে দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, একটি স্থায়ী শান্তি আলোচনা শুরু করা অত্যন্ত কঠিন।
এই আবহে, ভারত তার কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়েছে। ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল ক্রমাগত বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। সম্প্রতি ভারতের রাষ্ট্রদূত জাতিসংঘে পুনরায় বলেছেন যে, নয়াদিল্লি শান্তি স্থাপনের জন্য যেকোনো কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন করতে প্রস্তুত।
ইউক্রেনের বিদেশমন্ত্রী আন্দ্রি সিবিহা ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের সঙ্গে ফোনালাপে সরাসরি বলেছেন, “যুদ্ধ পুরোপুরি বন্ধ করার জন্য আমরা ভারতের প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর এবং সক্রিয় ভূমিকার উপর নির্ভর করি।”
কেন ভারতের ভূমিকা এত গুরুত্বপূর্ণ?
১. রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক: ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ঐতিহাসিক এবং কৌশলগত। প্রতিরক্ষা, শক্তি এবং মহাকাশ গবেষণার মতো ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে গভীর সহযোগিতা রয়েছে। এই সম্পর্কের ভিত্তিতে ভারত মস্কোকে আলোচনার টেবিলে আনতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে, যা পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষে সম্ভব নয়।
২. গ্লোবাল সাউথের নেতা: ভারত নিজেকে ‘গ্লোবাল সাউথ’ বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই দেশগুলো যুদ্ধের কারণে খাদ্য, জ্বালানি এবং সারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারত এই দেশগুলোর সম্মিলিত চাপকে ব্যবহার করে উভয় পক্ষকে শান্তি স্থাপনে রাজি করাতে পারে।
৩. নিরপেক্ষ অবস্থান: যুদ্ধের শুরু থেকেই ভারত কোনো পক্ষে যোগ না দিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিয়েছে, যা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকার জন্য অপরিহার্য।
সামগ্রিকভাবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদীর এই ফোনালাপ একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, বিশ্ব এখন ইউক্রেন সংকটের সমাধানে ভারতের দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। নয়াদিল্লি যদি তার কূটনৈতিক প্রজ্ঞা এবং কৌশলগত অবস্থানকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে, তবে এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে বিশ্ব শান্তিতে এক ঐতিহাসিক অবদান রাখতে পারে। তবে এই পথটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এবং এর সাফল্য নির্ভর করবে বিভিন্ন জটিল ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণের উপর।