ভারতের লাদাখ অঞ্চলে চিনের দুটি নতুন কাউন্টি প্রতিষ্ঠার ঘোষণার বিরুদ্ধে কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে “গভীর” প্রতিবাদ জানিয়েছে ভারত সরকার। সংসদে দেওয়া এক লিখিত জবাবে বিদেশ প্রতিমন্ত্রী কীর্তি বর্ধন সিং স্পষ্ট করে বলেছেন, “ভারত সরকার এই অঞ্চলে ভারতীয় ভূখণ্ডের অবৈধ চীনা দখলদারিতে কখনোই সম্মতি দেয়নি। নতুন কাউন্টি গঠন এই অঞ্চলের ওপর ভারতের দীর্ঘস্থায়ী এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ সার্বভৌমত্বের অবস্থানে কোনো প্রভাব ফেলবে না, বা চীনের অবৈধ ও জোরপূর্বক দখলদারিতে বৈধতাও দেবে না”।
প্রতিমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন যে সরকার চীনা পক্ষের হোটান প্রিফেক্চারে তথাকথিত দুটি নতুন কাউন্টির প্রতিষ্ঠার ঘোষণা সম্পর্কে অবগত আছে। এই তথাকথিত কাউন্টিগুলির এখতিয়ারের অংশবিশেষ ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখে পড়ছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, সরকার কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে “গম্ভীর প্রতিবাদ” নিবন্ধন করেছে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
চীনা সরকার ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রথম এই ঘোষণা করে যে তারা হোটান প্রিফেক্চারে হে’আন কাউন্টি এবং হেকাং কাউন্টি নামে দুটি নতুন প্রশাসনিক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছে। এই অঞ্চল, যা ভারতে খোটান নামেও পরিচিত, আকসাই চিনের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত – যা ভারত তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করে কিন্তু ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর থেকে চীনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
ইতিহাসের পাতায় ফিরে তাকালে দেখা যায়, চীন-ভারত সীমান্ত বিতর্ক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের সীমান্ত চুক্তি থেকে উৎপত্তি হয়েছে। আকসাই চিন অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সাথে সংযুক্ত ছিল। বর্তমানে চীন প্রায় ৩৮,০০০ বর্গ কিলোমিটার আকসাই চিন অঞ্চল দখল করে রেখেছে। এছাড়া, চীন অরুণাচল প্রদেশের ৯০,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার ওপরও দাবি করে, যাকে তারা “দক্ষিণ তিব্বত” বলে অভিহিত করে।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ভারত ও চীনের মধ্যে ৩,৪৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) বরাবর বিতর্কিত সীমান্ত রয়েছে, যা বিশ্বের দীর্ঘতম বিবাদমান সীমান্ত হিসেবে পরিচিত। ১৯৬২ সালে এই সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৮০ দশক থেকে এ পর্যন্ত সীমান্ত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ৫০ রাউন্ডেরও বেশি আলোচনা হয়েছে উভয় দেশের মধ্যে।
সম্প্রতি ২০২০ সালে গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সৈন্য শহীদ হয়েছিলেন। এরপর ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে, গালওয়ান সংঘর্ষের চার বছর পর, ভারত এবং চীন তাদের বিবাদমান সীমান্তে সামরিক গতিরোধ অবসানের একটি চুক্তিতে পৌঁছেতে সক্ষম হয়েছিল।
লোকসভায় প্রশ্ন করা হয়েছিল যে চীন হোটান প্রিফেক্চারে দুটি নতুন কাউন্টি প্রতিষ্ঠা করে লাদাখের ভারতীয় ভূখণ্ড অন্তর্ভুক্ত করেছে কিনা, এবং যদি তা হয়, তাহলে এই সমস্যা সমাধানে সরকার কী কৌশলগত ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে1। এছাড়াও প্রশ্ন করা হয়েছিল এই “কাউন্টি নির্মাণ” এর বিরুদ্ধে ভারত কী ধরনের প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং চীনা সরকারের কাছ থেকে কী প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে1।
উল্লেখযোগ্যভাবে, সরকার জানিয়েছে যে তারা চীন সীমান্ত অঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়ন করছে সে বিষয়ে অবগত রয়েছে। প্রতিরোধে, ভারত সরকারও সীমান্ত অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নে “সতর্ক ও বিশেষ মনোযোগ” দিচ্ছে, যা এই এলাকাগুলির অর্থনৈতিক বিকাশকে সহজতর করবে এবং ভারতের কৌশলগত ও নিরাপত্তা প্রয়োজনীয়তাও পূরণ করবে।
মন্ত্রী আরও জানিয়েছেন যে গত দশকে (২০১৪-২০২৪) সীমান্ত অবকাঠামোর জন্য বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশন (বিআরও) আগের দশকের তুলনায় তিনগুণ বেশি ব্যয় করেছে। সরকার সব ধরনের উন্নয়ন ও পরিবর্তন নজরে রাখছে যেগুলো ভারতের নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলতে পারে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সমস্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে মন্ত্রী উল্লেখ করেছেন।
সম্প্রতি অক্টোবর মাসে, দীর্ঘ চার বছরের গতিরোধের পর ভারত ও চীন লাদাখ অঞ্চলে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় টহল দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছেছি। এই সমঝোতা উভয় দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করতে পারে এবং ২০২০ সাল থেকে সৃষ্ট পরিস্থিতির সমাধানের পথ সুগম করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেছিলেন।
ভারত-চীন সীমান্ত বিতর্কের জটিলতা এবং দীর্ঘস্থায়িত্ব বিবেচনা করে, নতুন কাউন্টি প্রতিষ্ঠার এই পদক্ষেপ দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তবে ভারত তার সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় দৃঢ় অবস্থানের কথা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে এবং আগামীতেও এই অবস্থান অব্যাহত রাখবে বলে নিশ্চিত করেছে।