ভারতের উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন সিপি রাধাকৃষ্ণন। মঙ্গলবার সংসদে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি ৪৫২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতীয় বিরোধী জোট ইন্ডিয়া ব্লকের প্রার্থী বি সুদর্শন রেড্ডি পান ৩০০ ভোট। মোট ৭৬৭ ভোট পড়ে, যার মধ্যে ১৫টি অবৈধ বলে গণ্য হয়। নির্বাচনী কর্মকর্তা পিসি মোদি ফলাফল ঘোষণা করে জানান, রাধাকৃষ্ণন ভারতের পনেরতম উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
জুলাই মাসের ২১ তারিখে হঠাৎ করে স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগ করেন পূর্ববর্তী উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়। তার পদত্যাগের পর দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদটি শূন্য হয়ে পড়ে। এর ফলে নির্বাচন কমিশন নতুন উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঘোষণা দেয়।
চন্দ্রপুরম পন্নুস্বামী রাধাকৃষ্ণনের জন্ম ১৯৫৭ সালের ৪ মে তামিলনাড়ুর তিরুপুরে। তিনি একটি বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিগ্রি অর্জন করেন। রাধাকৃষ্ণন প্রথমে আরএসএস স্বয়ংসেবক হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি জনসংঘের রাজ্য নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে বিজেপি গঠিত হলে তিনি সেই দলে যোগ দেন।
রাজনৈতিক জীবনে রাধাকৃষ্ণনের গুরুত্বপূর্ণ মোড় আসে নব্বইয়ের দশকে। তিনি ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে কোয়েম্বাটুর লোকসভা আসন থেকে বিজয়ী হন। ১৯৯৮ সালে তিনি রেকর্ড ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি ভোটে জয়ী হন। পরের বছর ৫৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে আবারও বিজয়ী হন। এই সময় তিনি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি অন টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৪ সালে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভারতীয় সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে ভাষণ দেন। সেখানে তিনি মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। ২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি তামিলনাড়ু বিজেপির সভাপতি ছিলেন। এই সময় তিনি নদী সংযোগ, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে ১৯ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ৯৩ দিনের রথযাত্রা সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবনে রাধাকৃষ্ণনের আরও একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হল ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কয়ার বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন। তার নেতৃত্বে ভারতের কয়ার রপ্তানি ২৫৩২ কোটি রুপির রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছায়। ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি কেরলে বিজেপির দায়িত্বে ছিলেন।
শাসনিক দায়িত্বে রাধাকৃষ্ণন ২০২৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল হিসেবে শপথ নেন। প্রথম চার মাসেই তিনি রাজ্যের ২৪টি জেলার সবকটি পরিদর্শন করেন। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে তিনি তেলেঙ্গানার রাজ্যপাল ও পুদুচেরির লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অতিরিক্ত দায়িত্ব পান। পরবর্তীতে জুলাই ২০২৪-এ তিনি মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল হিসেবে নিয়োগ পান।
উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে রাধাকৃষ্ণনের নির্বাচন এনডিএ জোটের সংখ্যাগত শক্তির প্রমাণ। যদিও বিরোধী জোটের দাবি অনুযায়ী তাদের ৩১৫ সংসদ সদস্য একজোট ছিলেন, কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফলে রাধাকৃষ্ণন ৪৫২ ভোট পেয়েছেন। এটি প্রমাণ করে যে কিছু বিরোধী সংসদ সদস্য ক্রস ভোটিং করেছেন। মোট ১৫টি ভোট অবৈধ হয়েছে, যা পূর্বের উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনগুলোর মতোই।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাধাকৃষ্ণনের প্রার্থিতাকে “অসাধারণ উৎসাহ সৃষ্টিকারী” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, রাধাকৃষ্ণন একজন “চমৎকার উপরাষ্ট্রপতি” হবেন যিনি তার “প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টি” দিয়ে এই পদকে সমৃদ্ধ করবেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাধাকৃষ্ণনের জয় আরএসএস ও বিজেপির আদর্শগত ভিত্তির পাশাপাশি শাসনিক অভিজ্ঞতার সমন্বয়। তিনি তামিলনাড়ুর মতো চ্যালেঞ্জিং রাজ্যে বিজেপির জন্য কাজ করেছেন, যেখানে দলটির ঐতিহাসিকভাবে শক্ত অবস্থান নেই। তার সোজাসুজি কথা বলার স্বভাব এবং তুলনামূলক পরিচ্ছন্ন ইমেজ তাকে আলাদা করে তুলেছে।
বিরোধী দলের প্রার্থী বি সুদর্শন রেড্ডি পরাজয়ের পর বলেছেন, “আদর্শগত লড়াই আরও বেশি শক্তি নিয়ে অব্যাহত থাকবে।” কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেছেন, বিরোধী দলের এবারের পারফরম্যান্স “অত্যন্ত সম্মানজনক” ছিল। তিনি উল্লেখ করেছেন যে ২০২২ সালে মার্গারেট আলভা ২৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন, সেখানে এবার রেড্ডি ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন।
উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে রাধাকৃষ্ণন রাজ্যসভার এক্স-অফিসিও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। এই পদের জন্য নিরপেক্ষতা, প্রজ্ঞা এবং সংসদীয় কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ক্ষমতা প্রয়োজন। তার বিস্তৃত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা তাকে এই দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালনে সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রাধাকৃষ্ণনের উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও প্রশাসক হিসেবে তিনি দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে নিয়ে আসছেন দশকের পর দশকের কর্মঅভিজ্ঞতা। তার নেতৃত্বে রাজ্যসভার কার্যক্রম আরও শৃঙ্খলাবদ্ধ হবে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও শক্তিশালী হবে বলে প্রত্যাশা রয়েছে।