India next generation ICBM: ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও) নতুন প্রজন্মের আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। এই অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো শত্রুপক্ষের উন্নত অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক মিসাইল (এবিএম) প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। অগ্নি-৫ ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নত সংস্করণ এবং অগ্নি-৬ আইসিবিএম এই নতুন প্রজন্মের অস্ত্রভাণ্ডারের মূল ভিত্তি, যা ভারতকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর কাতারে এনে দাঁড় করাচ্ছে।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের এই নতুন ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনবে। ডিআরডিও সূত্রে জানা গেছে, অগ্নি-৫ ক্ষেপণাস্ত্রের নতুন সংস্করণটিকে ‘হাইপারসনিক’ ক্ষমতাসম্পন্ন করে গড়ে তোলা হচ্ছে, যার সর্বোচ্চ গতিবেগ হবে ৮ থেকে ২০ ম্যাক। এর অর্থ হলো এই ক্ষেপণাস্ত্র শব্দের গতির চেয়ে আট থেকে বিশ গুণ দ্রুত গতিতে চলতে পারবে, যা কোনো প্রচলিত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পক্ষে আটকানো অত্যন্ত কঠিন।
পরমাণু বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধজাহাজ! সামরিক শক্তিতে পাকিস্তান VS ভারত: কোথায়, কতটা এগিয়ে?
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, নতুন জাতের অগ্নি-৫কে ৭৫০০ কেজির বাঙ্কার বিধ্বংসী অস্ত্রে সজ্জিত করার গবেষণা চালাচ্ছে ডিআরডিও। এই ক্ষেপণাস্ত্রটি কংক্রিটের চাদরের নীচে, মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা শত্রুশিবির ধ্বংসের উপযোগী করে তোলা হচ্ছে। গবেষকদের দাবি অনুযায়ী, এই বোমা ফেটে পড়ার আগে মাটির ৮০ থেকে ১০০ মিটার গভীরে পৌঁছতে পারবে। তুলনামূলকভাবে, আমেরিকা ইরানের পরমাণু কেন্দ্রে যে জিবিইউ-৫৭ বাঙ্কার বিধ্বংসী বোমা ব্যবহার করেছিল, সেটি মাটির ২০০ মিটার নীচে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম।
অগ্নি-৬ আইসিবিএম প্রসঙ্গে বলতে গেলে, এটি ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর জন্য ডিআরডিও কর্তৃক উন্নয়নাধীন সবচেয়ে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র। অগ্নি-৬ অগ্নি মিসাইল প্রোগ্রামের সবচেয়ে উন্নত সংস্করণ হিসেবে পরিচিত এবং এটি সাবমেরিনের পাশাপাশি স্থল থেকেও উৎক্ষেপণ করা যাবে। ওয়ারহেড সহ এর রেঞ্জ ৮০০০-১০০০০ কিলোমিটার, যা এটিকে প্রকৃত অর্থেই একটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মর্যাদা দেয়।
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের এই উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি বিশেষ করে চীন এবং পাকিস্তানের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিল্লি থেকে বেজিং-এর দূরত্ব মাত্র ৩ হাজার কিলোমিটারের কিছু বেশি, যার অর্থ হলো অগ্নি-৫ বা অগ্নি-৬ উভয়ই চীনের যেকোনো প্রান্তে আঘাত হানতে সক্ষম। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তো এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর সামান্য অংশের শক্তিই যথেষ্ট।
ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অগ্নি ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। এই কর্মসূচি পরিচালনা করেন দেশের বিখ্যাত মহাকাশ বিজ্ঞানী রাম নারায়ণ আগরওয়াল। অগ্নি ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির আওতায় এখনও পর্যন্ত পাঁচটি প্রজন্মের উন্নয়ন সম্পন্ন হয়েছে। প্রথম অগ্নি-১ থেকে শুরু করে বর্তমান অগ্নি-৫ পর্যন্ত প্রতিটি সংস্করণেই উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হয়েছে।
ভারতের সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য কে-৬ হাইপারসনিক মিসাইলের সমুদ্র পরীক্ষা শুরুর প্রস্তুতি
বর্তমানে অগ্নি-৫ হল ভারতের হাতে থাকা একমাত্র ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল বা আইসিবিএম। সাধারণত যে ক্ষেপণাস্ত্র ৫ হাজার ৮০০ কিলোমিটার বা তার চেয়েও বেশি দূরে আঘাত হানতে সক্ষম হয় তাকেই আইসিবিএম-এর তালিকায় ফেলা হয়। ৫০ টন ওজনের এই ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্রটি ১৫০০ কিলোগ্রাম ওজনের পরমাণু অস্ত্রও বহন করতে পারে।
প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে, ভারতের নতুন ‘ক্যানিস্টারাইজড’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) এর রিপোর্ট অনুসারে, ভারতের নতুন ‘ক্যানিস্টারাইজড’ ক্ষেপণাস্ত্র, যা ওয়ারহেডগুলিকে আগে থেকে মাউন্ট করতে এবং আরও নিরাপদে পরিবহন করতে দেয়, এমনকি “শান্তিকালীন” সময়েও পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করতে পারে।
নৌ-ভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতেও ভারত অগ্রসর হচ্ছে। কে-৬ হাইপারসনিক মিসাইল ভারতের পরবর্তী প্রজন্মের সাবমেরিন-লঞ্চড ব্যালিস্টিক মিসাইল (এসএলবিএম) হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই মিসাইলটি ভারতের আগামী এস-৫ শ্রেণির পারমাণবিক সাবমেরিনে মোতায়েনের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। কে-৬ মিসাইলের হাইপারসনিক গতি এবং চালনা ক্ষমতা এটিকে প্রচলিত অ্যান্টি-মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত কঠিন করে তোলে।
আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে, বর্তমানে রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, ভারত, যুক্তরাজ্য এবং উত্তর কোরিয়া একমাত্র দেশ যাদের সক্রিয় আন্তঃমহাদেশীয় নিক্ষেপী ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এই তালিকায় ভারতের অন্তর্ভুক্তি দেশের প্রতিরক্ষা ক্ষমতার একটি বড় মাইলফলক।
https://www.india.com/news/india/meet-indias-next-generation-icbm-a-powerful-weapon-
প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ভারতের আত্মনির্ভরতার যাত্রায় এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সাম্প্রতিক ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি দেখে অস্ত্রভাঁড়ারের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে নয়াদিল্লি। ভবিষ্যতের যুদ্ধ কৌশলের কথা মাথায় রেখে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেদিকেই এগিয়ে চলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, এই উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি কেবল প্রতিরক্ষার জন্যই নয়, বরং কৌশলগত প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। হাইপারসনিক গতি এবং গোপনীয়তা শত্রুপক্ষের প্রতিক্রিয়ার সময়কে প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো পারমাণবিক বা প্রচলিত ওয়ারহেড উভয়ই বহন করতে পারে, যা ভারতের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নতুন মাত্রা দেয়।
চলমান গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে ভারত তার ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করে তুলছে। এস-৫ শ্রেণির সাবমেরিনগুলির নির্মাণ ২০২৭ সালের মধ্যে শুরু হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতীয় নৌবাহিনীতে যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সাবমেরিনগুলি উন্নত গোপনীয়তা বৈশিষ্ট্য এবং ভারী ওয়ারহেড বহনের ক্ষমতা দিয়ে সজ্জিত হবে।
ভারতের এই উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেই নয়, বরং দেশের সামগ্রিক কৌশলগত অবস্থানকেও শক্তিশালী করছে। বিশ্বের অন্যতম প্রধান সামরিক শক্তি হিসেবে ভারতের অবস্থান আরও মজবুত হচ্ছে এই অত্याধুনিক অস্ত্রপ্রযুক্তির কারণে। আগামী কয়েক বছরে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো পুরোপুরি কার্যকর হয়ে উঠলে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে।