নয়াদিল্লি, ৬ নভেম্বর ২০২৫: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সর্বশেষ ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে যে, ভারত এখন বিশ্বের শীর্ষ নম্বর এক ম্যানুফ্যাকচারিং লিডার হয়ে উঠেছে, চীনকে পিছনে ফেলে। এই অভূতপূর্ব অগ্রগতির পিছনে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগ, উৎপাদন খাতে বিদেশি বিনিয়োগের ঢেউ এবং সরকারি নীতির সাফল্য কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে। রিপোর্ট অনুসারে, ভারতের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের জিডিপি অবদান এখন ২১.৫ শতাংশ, যা চীনের ১৮.২ শতাংশকে ছাড়িয়ে গেছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সূচক নয়, বরং বিশ্ব শিল্পোন্নয়নের নতুন দিগন্তের ইঙ্গিত দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিবর্তন গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনের ভারসাম্য বদলে দেবে।
এই খবরটি বিশ্বব্যাপী মিডিয়ায় ঝড় তুলেছে, কারণ দীর্ঘদিন ধরে চীনকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানুফ্যাকচারিং জায়ান্ট হিসেবে দেখা হতো। আইএমএফের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের তুলনায় ভারতের উৎপাদন খাতের বৃদ্ধির হার ১৬.৮ শতাংশ, যখন চীনেরটি মাত্র ৪.২ শতাংশ। এই ফারাকের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ভারতের শ্রমশক্তির প্রাপ্যতা, ডিজিটাল ইনফ্রাস্ট্রাকচারের উন্নয়ন এবং ট্যারিফ-মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। ভারত সরকারের অর্থ মন্ত্রক জন হাভসি বলেছেন, “এটি আমাদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার (আত্মনির্ভর ভারত) সফলতার প্রমাণ।” এই পরিসংখ্যানগুলি শুধু সংখ্যা নয়, বরং লক্ষ লক্ষ চাকরির সৃষ্টি এবং রপ্তানির বৃদ্ধির প্রতিফলন।
‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগের যাত্রা ২০১৪ সালে শুরু হয়েছিল, যখন ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের জিডিপি অবদান ছিল মাত্র ১৬ শতাংশের নিচে। গত এক দশকে এই খাতে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের বেশি বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসার ফলে পরিস্থিতি বদলে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইলেকট্রনিক্স এবং অটোমোবাইল সেক্টরে ভারত এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদক, যা আইএমএফ রিপোর্টে উল্লেখিত। চীনের ক্ষেত্রে, জিওপলিটিক্যাল টেনশন এবং কর্মী অভাবের কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, যা তাদের লিডারশিপকে চ্যালেঞ্জ করছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক সাম্প্রতিক টুইটে লিখেছেন, “ভারতের শিল্পোন্নয়নের এই উত্থান প্রত্যেক ভারতীয়ের জন্য গর্বের বিষয়। আমরা বিশ্বের কারখানা হয়ে উঠছি!” এই বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজার হাজার লাইক এবং শেয়ার পেয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় এই খবর নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে। টুইটারে (এক্স) হ্যাশট্যাগ #IndiaManufacturingLeader ট্রেন্ড করছে, যেখানে ব্যবহারকারীরা ভারতের অর্থনৈতিক উত্থানকে উদযাপন করছেন। একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রাহুল মিশ্র টুইট করেছেন, “আইএমএফের এই রিপোর্ট চীনের মনোবল ভাঙার মতো। ভারতের ম্যানুফ্যাকচারিং লিডার হওয়া গ্লোবাল ট্রেডের নতুন যুগের সূচনা।” অন্যদিকে, কিছু সমালোচক পয়েন্ট করছেন যে, এই পরিসংখ্যান স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী টেকসইতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যাইহোক, ইন্ডাস্ট্রি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের সাপ্লাই চেইনের বৈচিত্র্য এটিকে চীনের মতো একক-কেন্দ্রিকতা থেকে রক্ষা করবে। এই আলোচনাগুলি দেখাচ্ছে যে, খবরটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং জাতীয় গর্বের বিষয় হয়ে উঠেছে।
ভারতের এই ম্যানুফ্যাকচারিং লিডারশিপের পটভূমিতে ফিরে তাকালে, মহামারীকালীন সময়ে চীন-কেন্দ্রিক সাপ্লাই চেইনের ঝুঁকি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২০২০-২১ সালে বিশ্বের অনেক দেশ ভারতের দিকে ফিরে আসে, যা ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশলের অংশ। ফলস্বরূপ, অ্যাপল, স্যামসাং এবং টাটা গ্রুপের মতো কোম্পানিগুলি ভারতে তাদের উৎপাদন ঘরানা স্থানান্তর করে। আইএমএফের তথ্যে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ভারতের ম্যানুফ্যাকচারিং রপ্তানি ৩৫% বেড়েছে, যা চীনের ৮% বৃদ্ধির চেয়ে অনেক বেশি। এই খাতে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণও বেড়েছে ২৫ শতাংশে, যা সামাজিক উন্নয়নের আরেক দিক। বিশ্বব্যাঙ্কের এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, “ভারতের উৎপাদন খাতের এই গতি দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক মডেলকে পুনর্নির্মাণ করবে।” এই বিকাশের ফলে লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতী চাকরি পাচ্ছেন, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়।
চীনের দিক থেকে এই পরিবর্তনকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিজনেস মিডিয়া। পেকিং-ভিত্তিক ‘চায়না ডেইলি’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ভারতের দ্রুত উত্থান চীনের উৎপাদন সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করছে, কিন্তু আমরা আমাদের ডিজিটালাইজেশন দিয়ে প্রত্যাবর্তন করব।” এদিকে, ভারতে শিল্পপতিরা উচ্ছ্বসিত। কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি (সিআইআই) এর চেয়ারম্যান বলেছেন, “আইএমএফের এই স্বীকৃতি আমাদের ম্যানুফ্যাকচারিং লিডার হিসেবে নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। আমরা এখন গ্লোবাল ইনভেস্টরদের জন্য প্রথম পছন্দ।” সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যবহারকারীরা মিম এবং ভিডিও শেয়ার করে এই সাফল্যকে উদযাপন করছেন, যেমন একটি ভাইরাল পোস্টে লেখা, “চীনের পরিবর্তে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ – এটাই ভবিষ্যৎ!” এই প্রতিক্রিয়াগুলি দেখাচ্ছে যে, খবরটি জাতীয়তাবাদী অনুভূতিকেও জাগিয়ে তুলেছে। তবে, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, ইনফ্রাস্ট্রাকচার এবং দক্ষতা উন্নয়ন ছাড়া এই লিডারশিপ টেকসই হবে না।
এই অগ্রগতির আরেক দিক হলো পরিবেশ-সচেতন উৎপাদন। ভারত সরকারের ‘গ্রিন ম্যানুফ্যাকচারিং’ নীতির ফলে কার্বন নির্গমন কমছে, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কার্বন বর্ডার ট্যাক্স এড়াতে সাহায্য করবে। আইএমএফ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের এই খাতে পুনর্নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার ৪০% ছাড়িয়েছে, যা চীনের ৩২% এর চেয়ে ভালো। এটি বিশ্বের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অটোমোবাইল সেক্টরে ইলেকট্রিক ভেহিকল (ইভি) উৎপাদন ভারতে ৫০% বেড়েছে, যা টেসলার মতো কোম্পানিগুলিকে আকৃষ্ট করছে। এই বিকাশের ফলে ভারতের মোট রপ্তানি ২০২৫ সালে ৭৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, যার ৩৫% ম্যানুফ্যাকচার্ড গুডস। বিশ্ব ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডব্লিউটিও) এর এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, “ভারতের ম্যানুফ্যাকচারিং লিডারশিপ এশিয়ার অর্থনৈতিক ভারসাম্য পুনঃস্থাপন করবে।” এই পরিবর্তন শুধু অর্থের নয়, বরং কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের এই উত্থানের প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে বিস্তৃত। আমেরিকা এবং ইউরোপের কোম্পানিগুলি এখন ভারতকে প্রাধান্য দিচ্ছে, যা চীনের উপর নির্ভরতা কমাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, গুগল এবং অ্যামাজনের মতো টেক জায়ান্টরা ভারতে তাদের হার্ডওয়্যার উৎপাদন শুরু করেছে। এই খাতে স্টার্টআপের সংখ্যাও বেড়েছে ৩০%, যা উদ্ভাবনকে ত্বরান্বিত করছে। তবে, চ্যালেঞ্জ রয়েছে – যেমন দক্ষ শ্রমিকের অভাব এবং লজিস্টিক খরচ। সরকার এখন ‘প্লাটো টু প্লাটো’ হাইওয়ে এবং স্কিল ইন্ডিয়া প্রোগ্রামের মাধ্যমে এগুলি মোকাবিলা করছে। আইএমএফের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেছেন, “ভারতের ম্যানুফ্যাকচারিং লিডার হওয়া উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য অনুকরণীয় মডেল।” এই বক্তব্য বিশ্ব নেতাদের মধ্যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারতীয় ডায়াস্পোরা এটিকে ‘ভারতের স্বর্ণযুগ’ বলে অভিহিত করছে।
এই অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মানবিক দিকটিও উল্লেখযোগ্য। ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ১ কোটির বেশি নতুন চাকরি সৃষ্টি হয়েছে গত পাঁচ বছরে, যার মধ্যে ৪০% নারী। এটি দারিদ্র্য হ্রাস এবং শিক্ষার সুযোগ বাড়িয়েছে। উত্তরপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যগুলিতে শিল্প ক্লাস্টার গড়ে উঠছে, যা আঞ্চলিক বৈষম্য কমাচ্ছে। তবে, পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সবুজ প্রযুক্তির উপর জোর দিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি ভারত এই গতি বজায় রাখে, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি ছাড়িয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসবে। এই রিপোর্টের পর ভারতীয় শেয়ারবাজারে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের সূচক ৫% উঠেছে, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা দেখায়।











