India Pakistan ceasefire talks 2025: সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর থেকেই ভারতীয় রাজনৈতিক মহলে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ প্রকটভাবে উঠে এসেছে। গত ১০ মে, ২০২৫ তারিখে চার দিনের পাল্টাপাল্টি সামরিক হামলার পর উভয় দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরপরই ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তাতে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের প্রসঙ্গ নিয়ে ভারতে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। কিন্তু কেন এই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এসেছে? কী এমন সাদৃশ্য আছে যে, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বর্তমান পরিস্থিতি এবং ১৯৭১-এর মধ্যে তুলনা টানছেন?
সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির পটভূমি
সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির আগে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করেছিল। গত ৬ মে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান ‘অপারেশন বুনইয়ানুম মারসৌস’ নামক অভিযান শুরু করে। এরপর দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি মিসাইল হামলার একটি মারাত্মক পর্ব শুরু হয়। ভারত ও পাকিস্তানের বড় বড় শহরের আকাশে মিসাইল এবং ড্রোন হামলা চলতে থাকে চার দিন ধরে, যা ক্রমশ সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল বলে মনে করা হচ্ছিল।
১০ মে বিকেলে হঠাৎ করেই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রির মতে, পাকিস্তানই প্রথম যুদ্ধবিরতি চেয়েছিল এবং ভারতের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেছিল। যুদ্ধবিরতির ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে পাকিস্তানের একজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর বেলা ৩টা ৩৫ মিনিটে উভয় দেশের সামরিক অভিযান পরিচালনাকারী (ডিজিএমও) প্রধানরা আলোচনায় বসেন এবং ভারতীয় সময় বিকেল ৫টায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
অন্যদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এই যুদ্ধবিরতি সম্ভব হয়েছে। তিনি তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ পোস্ট করে জানান যে, ‘ভারত আর পাকিস্তান সম্পূর্ণ আর তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে’ এবং এই সিদ্ধান্তে আসতে ‘যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় রাতব্যাপী দীর্ঘ আলোচনা’ হয়েছে।
৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ: এক নজরে ইতিহাস
১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, যা তৃতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবেও পরিচিত, এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। এই যুদ্ধের শুরু হয় ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর, যখন পাকিস্তান ‘অপারেশন চেঙ্গিজ খান’ নামে ভারতের এগারোটি বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায়। এই হামলার পর, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তির পক্ষে সরাসরি অংশগ্রহণ করে।
প্রকৃতপক্ষে, ভারতের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ছিল সময়ের ব্যাপার। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানী বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা চালানোর পর থেকেই ভারত পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। কয়েক মাসের মধ্যেই প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়, যা ভারতের জন্য এক বিশাল মানবিক সংকট তৈরি করে।
যুদ্ধে ভারতের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের পর, মিত্র বাহিনী গঠিত হয় এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে। মাত্র ১৩ দিনের যুদ্ধে ভারত স্পষ্ট আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড ঢাকায় আত্মসমর্পণ করে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ নামে এক নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
বর্তমান যুদ্ধবিরতিতে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসার কারণ
বর্তমান ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির পর মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠে আসার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে:
শক্তি ভারসাম্যের প্রদর্শন: ভারতের রাজনৈতিক মহল ১৯৭১ সালের যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে আনছে শক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। ৭১-এর যুদ্ধে ভারত পাকিস্তানকে পরাজিত করেছিল এবং তাদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভারত পাকিস্তানকে বোঝাতে চাইছে যে, যুদ্ধ হলে পাকিস্তানের জন্য পরিণাম সুখকর হবে না।
রাজনৈতিক সুবিধা: ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি, বিশেষ করে কংগ্রেস, মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠিয়েছে। এটি তাদের জন্য রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে লাভজনক, কারণ ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকারই ছিল ক্ষমতায়, যারা বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিল।
ঐতিহাসিক বিজয়ের স্মৃতি: ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ভারতের জন্য এক উল্লেখযোগ্য সামরিক বিজয়। মাত্র ১৩ দিনের যুদ্ধে পাকিস্তানের ৯৩,০০০ সেনাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা ভারতের জন্য এক বড় ইতিহাস। এই বিজয়ের স্মৃতি পুনরায় জাগিয়ে তুলে ভারত নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে চাইছে।
মধ্যস্থতার প্রসঙ্গ: বর্তমান যুদ্ধবিরতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার দাবি এবং ১৯৭১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতার মধ্যে তুলনা করা হচ্ছে। ১৯৭১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পক্ষে ছিল, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে এই ঐতিহাসিক তুলনা আজ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন বনাম আমেরিকা: মধ্যস্থতার রাজনীতি
৭১-এর যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পক্ষে ছিল এবং যুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযানে সমর্থন দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে আশ্বাস দিয়েছিল যে, যদি যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের সাথে কোনো সংঘর্ষ ঘটে, তবে তারা পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। এই আশ্বাস ১৯৭১ সালের আগস্টে স্বাক্ষরিত ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র তৎকালীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। যুদ্ধের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারে যে ভারত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানে আক্রমণ করে দেশটি ভেঙে দিতে পারে। ১০ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট নিক্সন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেজনেভের সঙ্গে কথা বলেন এবং ভারতকে সংযত করতে আহ্বান জানান।
বর্তমানে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দাবি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি সম্ভব হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক নতুন দ্বন্দ্বের সূচনা করতে পারে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র এখনও পাকিস্তানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে।
ভৌগোলিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: তখন এবং এখন
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে চলমান গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ভারত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ভারতের মাটিতে বসেই পরিচালিত হয়েছিল এবং ভারত মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর ভারতের পার্লামেন্টে দেয়া এক বিবৃতির মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
বর্তমানে, ভারত কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের সাথে দীর্ঘদিনের বিরোধ চালিয়ে আসছে। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করেই ভারত-পাকিস্তানের সবগুলো যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছে। বর্তমান যুদ্ধবিরতি কতদিন স্থায়ী হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে, কারণ দুই দেশই যুদ্ধবিরতির পরপরই এক অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে।
সংকট থেকে সহযোগিতা: ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
বর্তমান যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে আরও অনেক বাধা রয়েছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র নতুন শক্তির ভারসাম্য মেনে নিয়ে ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। পরবর্তী কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে কাজ করেছিল।
বর্তমান পরিস্থিতিতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে যুদ্ধবিরতি সম্ভব হলেও, দুই দেশের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক প্রয়াস প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠে আসা এই বার্তাই দেয় যে, ভারত এখনও ৭১-এর বিজয়কে একটি কূটনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠে আসা প্রমাণ করে যে, ইতিহাস আজও রাজনৈতিক কূটনীতির অংশ। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় ও ভারতের বিজয়কে স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভারত পাকিস্তানকে বোঝাতে চাইছে যে, সংঘাতের পথ বেছে নেওয়া উচিত নয়।
তবে, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে দুই দেশকে এগিয়ে যাওয়াই বর্তমান সময়ের দাবি। পারমাণবিক অস্ত্রধর প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সংঘাত শুধু উপমহাদেশ নয়, সারা বিশ্বের জন্যই হুমকিস্বরূপ। তাই যুদ্ধবিরতিকে স্থায়ী শান্তিতে রূপান্তরিত করার জন্য আন্তরিক প্রয়াস এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যত গড়ার পথেই দুই দেশের মঙ্গল নিহিত – এটিই বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তাই শুধুই অতীতের স্মৃতিচারণ নয়, বরং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাও বটে।