আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের চেনা ছবিটা এবার আমূল বদলে যাচ্ছে। মার্কিন ডলারের একাধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ভারত ও রাশিয়া তাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের সিংহভাগ লেনদেন নিজস্ব মুদ্রা অর্থাৎ রুপি ও রুবলে সম্পন্ন করছে। সম্প্রতি পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের ৯০ শতাংশেরও বেশি এখন এই নতুন ব্যবস্থায় হচ্ছে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। নয়াদিল্লি এবং মস্কোর এই পদক্ষেপ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, এর একটি বলিষ্ঠ ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্যও রয়েছে।
এই যুগান্তকারী পরিবর্তনের মূলে রয়েছে দুই দেশের মধ্যেকার এক বিশেষ চুক্তি, যা ডলারের উপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের মুদ্রাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে তৈরি। ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে রাশিয়ার উপর पश्चिमी বিশ্বের আরোপিত কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে এই প্রক্রিয়াটি আরও গতি পেয়েছে। রাশিয়ার পক্ষে ডলার বা ইউরোতে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়ায় তারা বিকল্প পথের সন্ধান শুরু করে এবং ভারতের মতো বন্ধু দেশগুলোর সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য করার দিকে ঝোঁকে। ভারতের কাছেও এটি একটি বড় সুযোগ হিসেবে আসে, কারণ এর ফলে একদিকে যেমন সস্তায় রুশ তেল ও অন্যান্য সামগ্রী আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে, তেমনই ডলারের তুলনায় রুপির অস্থিরতা থেকেও কিছুটা রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে।
কীভাবে কাজ করছে এই রুপি-রুবল ব্যবস্থা? এই প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘ভোস্ট্রো অ্যাকাউন্ট’ (Vostro Account)। রাশিয়ার একাধিক ব্যাংক, যেমন Sberbank এবং VTB Bank, ভারতের বিভিন্ন ব্যাংকে ভারতীয় রুপিতে অ্যাকাউন্ট খুলেছে। যখন কোনো ভারতীয় আমদানিকারক রাশিয়া থেকে কোনো পণ্য (যেমন, অপরিশোধিত তেল) কেনেন, তখন তাকে আর ডলারে মূল্য পরিশোধ করতে হয় না। তিনি সরাসরি সেই রাশি ভারতীয় টাকায় রাশিয়ার ব্যাংকের ভারতীয় শাখায় থাকা ভোস্ট্রো অ্যাকাউন্টে জমা করে দেন। একইভাবে, কোনো রুশ আমদানিকারক ভারত থেকে পণ্য কিনলে তার মূল্য রুবলে পরিশোধ করেন, যা ভারতের কোনো ব্যাংকের রাশিয়াতে থাকা অ্যাকাউন্টে জমা হয়। এই ব্যবস্থায় কোনো তৃতীয় মুদ্রার প্রয়োজন হয় না এবং আন্তর্জাতিক লেনদেন নিষ্পত্তির জন্য ব্যবহৃত SWIFT সিস্টেমকেও এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
অবশ্য এই ব্যবস্থা একেবারে নতুন নয়। স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের একই ধরনের একটি বাণিজ্যিক ব্যবস্থা চালু ছিল, যা রুপি-রুবল বাণিজ্য চুক্তি নামে পরিচিত। সেই সময়েও দুই দেশ একে অপরের মুদ্রায় লেনদেন করত। বর্তমান ব্যবস্থাটি সেই পুরনো কাঠামোরই একটি আধুনিক সংস্করণ, তবে আজকের বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। অতীতে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি থাকলেও তা এতটা বিপুল ছিল না। বর্তমানে রাশিয়া থেকে ভারতের আমদানির পরিমাণ, বিশেষ করে জ্বালানি তেলের কারণে, বহুগুণ বেড়ে গেছে। এর ফলে রাশিয়ার কাছে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় রুপি জমা হচ্ছে।
এই নতুন ব্যবস্থায় ভারত নিঃসন্দেহে লাভবান হয়েছে। প্রথমত, ডলারের ঘাটতি বা এর বিনিময় হারের ওঠানামার ঝুঁকি অনেকটাই কমেছে। দ্বিতীয়ত, রাশিয়া থেকে বিপুল ছাড়ে অপরিশোধিত তেল আমদানি করার ফলে ভারতের মুদ্রাস্ফীতির উপর চাপ কমেছে এবং বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হয়েছে। অন্যদিকে, রাশিয়ার দিক থেকে দেখলে, নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েও তারা তাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পারছে। ভারতের মতো একটি বিশাল বাজারে নিজেদের পণ্য বিক্রি করে তারা আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতাকে কিছুটা হলেও প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে।
তবে এই ব্যবস্থার সামনে কিছু বড় চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দুই দেশের মধ্যেকার বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি। ভারত রাশিয়া থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করে, তার তুলনায় রপ্তানি করে খুবই কম। ফলে রাশিয়ার ভারতীয় ব্যাংকগুলোতে থাকা ভোস্ট্রো অ্যাকাউন্টগুলোতে হাজার হাজার কোটি রুপি জমে পাহাড় হয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া এই বিপুল পরিমাণ রুপি দিয়ে কী করবে, তা নিয়ে একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয়েছে। যেহেতু রুপি আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার বা ইউরোর মতো সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা নয়, তাই রাশিয়া এই অর্থ অন্য কোনো দেশ থেকে পণ্য কেনার জন্য ব্যবহার করতে পারছে না।
এই সমস্যার সমাধানে ইতিমধ্যেই দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। একটি প্রস্তাব হলো, রাশিয়া এই জমে থাকা রুপি ভারতের শেয়ার বাজার বা সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারে। এর ফলে ভারতের অর্থনীতিতে যেমন বিদেশি বিনিয়োগ আসবে, তেমনই রাশিয়ার অর্থও আটকে থাকবে না। আরেকটি সম্ভাব্য সমাধান হলো, ভারত থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি বাড়ানো। ভারত থেকে ফার্মাসিউটিক্যালস, গাড়ির যন্ত্রাংশ, রাসায়নিক এবং কৃষি পণ্যের মতো বিভিন্ন সামগ্রী রাশিয়ায় রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। যদি ভারত তার রপ্তানির পরিমাণ বাড়াতে পারে, তবে এই বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা হলেও কমবে এবং রুপি-রুবল ব্যবস্থাটি আরও স্থিতিশীল হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারত ও রাশিয়ার এই পদক্ষেপ বিশ্বজুড়ে ‘ডি-ডলারাইজেশন’ বা ডলারের প্রভাব কমানোর যে প্রবণতা শুরু হয়েছে, তাকে আরও শক্তিশালী করবে। চীন, ব্রাজিল, সৌদি আরবের মতো দেশগুলোও ধীরে ধীরে মার্কিন ডলারের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে। ব্রিকস (BRICS) গোষ্ঠীর দেশগুলোও নিজেদের মধ্যে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করছে। ভারত-রাশিয়ার এই সফল মডেল অন্য দেশগুলোকেও এই পথে হাঁটতে উৎসাহিত করতে পারে। যদিও ডলারকে পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করা সহজ নয়, তবে এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলো আগামী দিনে বিশ্ব অর্থনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্যকে নিঃসন্দেহে দুর্বল করবে এবং একটি বহুমেরু কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে, যেখানে রুপি এবং রুবলের মতো মুদ্রাগুলোর ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।