ভারতের কোন শহরটি জুতার শহর নামে পরিচিত?

আগ্রা, যা বিশ্বজুড়ে তাজমহলের জন্য বিখ্যাত, সেই শহরটিই ভারতের "জুতার শহর" বা "ফুটওয়্যার ক্যাপিটাল" নামে পরিচিত। উত্তরপ্রদেশের এই ঐতিহাসিক শহরটি কেবলমাত্র স্থাপত্যের নিদর্শনের জন্যই নয়, বরং দেশের পাদুকা শিল্পের সবচেয়ে…

Ishita Ganguly

 

আগ্রা, যা বিশ্বজুড়ে তাজমহলের জন্য বিখ্যাত, সেই শহরটিই ভারতের “জুতার শহর” বা “ফুটওয়্যার ক্যাপিটাল” নামে পরিচিত। উত্তরপ্রদেশের এই ঐতিহাসিক শহরটি কেবলমাত্র স্থাপত্যের নিদর্শনের জন্যই নয়, বরং দেশের পাদুকা শিল্পের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র হিসেবেও বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। মুঘল যুগ থেকে শুরু হওয়া এই শিল্প আজ ভারতের ৬৫% দেশীয় চাহিদা পূরণ করে এবং দেশের মোট পাদুকা রপ্তানির ২৮-৩৫% অবদান রাখে।

আগ্রা কেন জুতার শহর হিসেবে বিখ্যাত?

আগ্রা শহরে প্রায় ৫,০০০ থেকে ১০,০০০টি ছোট-বড় পাদুকা উৎপাদন ইউনিট রয়েছে, যেখানে প্রতিদিন ৩ লাখ থেকে ৫ লাখ জোড়া জুতা তৈরি হয়। শহরের জনসংখ্যার প্রায় ৬০% মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই শিল্পের সাথে যুক্ত, যা প্রায় ৪ লাখেরও বেশি মানুষকে কর্মসংস্থানের সুযোগ দেয়।

ঐতিহাসিক পটভূমি

আগ্রার পাদুকা শিল্পের ইতিহাস মুঘল যুগের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। পঞ্চদশ শতাব্দীতে এই শিল্পের সূচনা হয়, এবং ভারতে প্রথম চামড়ার জুতা তৈরি হয় আগ্রাতেই। মুঘল শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এখানকার কারিগররা হস্তনির্মিত জুতা তৈরির ঐতিহ্যবাহী কৌশল আয়ত্ত করেন, যা আজও অব্যাহত রয়েছে। বিশেষত হিং কি মান্ডি এলাকাটি এই ঐতিহ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত।

উৎপাদন ক্ষমতা ও বৈচিত্র্য

আগ্রার পাদুকা শিল্প বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদন করে – পুরুষদের চামড়ার জুতা, মহিলাদের ডিজাইনার স্যান্ডেল এবং চপ্পল, শিশুদের জুতা, এবং বিভিন্ন ধরনের ফ্যাশনেবল পাদুকা। বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৪.৫ কোটি থেকে ১২ কোটি জোড়া জুতা, যার মধ্যে ২.২ কোটি জোড়া চপ্পল ও স্যান্ডেল।

জয়পুর থেকে কলকাতা – বিদেশি পর্যটকদের পছন্দের ভারতীয় শহরগুলি

আগ্রা পাদুকা শিল্পের প্রধান কেন্দ্রসমূহ

আগ্রা শহরের বিভিন্ন এলাকা পাদুকা উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এই বাজারগুলো এশিয়ার সবচেয়ে বড় পাদুকা বাজার গঠন করে:

  • হিং কি মান্ডি: আগ্রার পাদুকা শিল্পের হৃদয়, যেখানে সবচেয়ে বেশি কর্মকাণ্ড হয়

  • নাই কি মান্ডি: ঐতিহ্যবাহী জুতা তৈরির কেন্দ্র

  • তাজগঞ্জ ও বোদলা: চামড়ার পণ্যের জন্য পরিচিত

  • সদর ভাট্টি ও জগদীশপুরা: ছোট ও মাঝারি আকারের উৎপাদন ইউনিট

  • রাজা মান্ডি, শাহগঞ্জ, লোহা মান্ডি: পাইকারি বাজার

এই বাজারগুলোতে প্রায় ৫,০০০টি পাদুকার দোকান রয়েছে, যেখানে দেশ-বিদেশের ক্রেতারা পণ্য ক্রয় করতে আসেন।

উৎপাদন কাঠামো ও কর্মসংস্থান

আগ্রার পাদুকা শিল্প বিভিন্ন স্তরের উৎপাদন ইউনিট নিয়ে গঠিত:

উৎপাদন ইউনিটের ধরন সংখ্যা বৈশিষ্ট্য
কুটির শিল্প ইউনিট প্রায় ৫,০০০ হস্তনির্মিত, ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি
যান্ত্রিক/আধা-যান্ত্রিক ইউনিট প্রায় ২৫০ মধ্যম আকারের উৎপাদন
ক্ষুদ্র-স্কেল শিল্প ইউনিট প্রায় ১৫০ আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার
মাঝারি-স্কেল ইউনিট প্রায় ৩০ বড় পরিমাণে উৎপাদন
বৃহৎ-স্কেল ইউনিট প্রায় ১৫ রপ্তানিমুখী উৎপাদন
কর্মসংস্থানের চিত্র

আগ্রার পাদুকা শিল্প সরাসরি প্রায় ৪ লাখ মানুষকে কর্মসংস্থান দেয়, এবং পরোক্ষভাবে আরও কয়েক লাখ মানুষ এই শিল্পের সাথে জড়িত। শহরের জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ এই শিল্পের উপর নির্ভরশীল। নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৭৫,০০০ কর্মী এবং অনিবন্ধিত ইউনিটে প্রায় ১,২৫,০০০ কর্মী কাজ করেন।

ভারতের অর্থনীতিতে আগ্রার অবদান

আগ্রা ভারতের প্রধান পাদুকা উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে দেশের দেশীয় চাহিদার ৬৫% পূরণ করে এবং মোট পাদুকা রপ্তানির ২৮-৩৫% অবদান রাখে। ২০২৪ সালে ভারতের পাদুকা বাজারের মূল্য প্রায় ১৭.৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল, এবং ২০৩২ সাল নাগাদ তা ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

রপ্তানি পরিস্থিতি

আগ্রার বার্ষিক জুতার ব্যবসায় পরিমাণ ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। ভারতের চামড়া রপ্তানি ২০২০-২১ সালে ৩,৬৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৪-২৫ সালে ৪,৮২৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা ৩১% বৃদ্ধি। এই রপ্তানির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আগ্রা থেকে হয়।

প্রধান রপ্তানি বাজার

আগ্রা থেকে জুতা রপ্তানি হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে:

  • মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (সর্বোচ্চ রপ্তানি, ২০২০-২১ সালে ৬৪৫ মিলিয়ন থেকে ২০২৪-২৫ সালে ১,০৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)

  • যুক্তরাজ্য

  • জার্মানি ও ফ্রান্স

  • ইতালি ও স্পেন

  • রাশিয়া ও কানাডা

  • নেদারল্যান্ডস

  • দক্ষিণ আফ্রিকা

  • ডেনমার্ক ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ

আগ্রার পাদুকা শিল্পের বিশেষত্ব

গুণমান ও কারিগরি দক্ষতা

আগ্রার কারিগররা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চামড়ার জুতা তৈরির ঐতিহ্যবাহী কৌশল রক্ষা করে চলেছেন। এখানে তৈরি হওয়া জুতার গুণমান এত উন্নত যে তা শুধুমাত্র ভারতেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। হস্তনির্মিত জুতাগুলো বিশেষভাবে মর্যাদাপূর্ণ এবং উচ্চমানের জন্য পরিচিত।

পণ্যের বৈচিত্র্য

আগ্রায় উৎপাদিত পাদুকার মধ্যে রয়েছে:

  • পুরুষদের জন্য: মোকাসিন, ডার্বি, ফরমাল জুতা, ঐতিহ্যবাহী জুতি

  • মহিলাদের জন্য: সূচিকর্ম, পুঁতি এবং কাপড়ের সাজসজ্জা সহ ডিজাইনার স্যান্ডেল, মসরি, চপ্পল

  • শিশুদের জন্য: চামড়ার স্যান্ডেল, খেলার জুতা

  • বিশেষ পণ্য: চামড়ার ব্যাগ, পার্স, বেল্ট এবং অ্যাক্সেসরিজ

কাঁচামাল ও সরবরাহ নেটওয়ার্ক

আগ্রার পাদুকা শিল্পের একটি বড় সুবিধা হলো কাঁচামালের পর্যাপ্ত প্রাপ্যতা এবং শক্তিশালী সরবরাহকারী নেটওয়ার্ক। ভেড়া, মহিষ এবং ছাগলের চামড়া থেকে বিভিন্ন ধরনের পাদুকা তৈরি হয়। এছাড়াও, সিন্থেটিক উপাদান ব্যবহার করেও উচ্চমানের পাদুকা উৎপাদন হয়।

বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা

আগ্রার পাদুকা শিল্প বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন:

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ:

  • কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি উৎপাদন খরচ বাড়াচ্ছে

  • সস্তা আমদানিকৃত পণ্য স্থানীয় শিল্পের জন্য প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করছে

  • জিএসটি-র প্রভাব ছোট ইউনিটগুলির জন্য বোঝা

নীতিগত সমস্যা:

  • গো-মাংস নিষিদ্ধতা চামড়া সরবরাহে প্রভাব ফেলছে

  • আন্তর্জাতিক বাজারে শুল্ক বৃদ্ধি, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫০% শুল্কের হুমকি

প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ:

  • আধুনিকীকরণের অভাব অনেক ছোট ইউনিটে

  • দক্ষ কারিগরদের নতুন প্রজন্মের অভাব

সরকারি উদ্যোগ ও সহায়তা

ভারত সরকার এবং রাজ্য সরকার আগ্রার পাদুকা শিল্পকে সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এএফএমইসি (Agra Footwear Manufacturers and Exporters Chamber), সিএলই (Council for Leather Exports), এবং সিএফটিআই-এর মতো সংগঠনগুলি শিল্পকে সহায়তা প্রদান করছে। ২০২৫ সালে আগ্রা ফুটওয়্যার এক্সপো আয়োজন করা হচ্ছে, যা B2B সংযোগ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ দেবে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

আগ্রার পাদুকা শিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। ভারতের পাদুকা বাজার ১২.৩৯% বার্ষিক বৃদ্ধির হারে বাড়ছে এবং ২০৩২ সাল নাগাদ ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে। আগ্রা, যা বর্তমানে চীনের পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম পাদুকা উৎপাদনকারী দেশ ভারতের প্রধান কেন্দ্র, এই বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

উন্নয়নের সম্ভাবনা

  • ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিক্রয় বৃদ্ধি: অনলাইন বাজার আগ্রার জুতাকে দেশ-বিদেশে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করছে

  • টেকসই উৎপাদন পদ্ধতি: পরিবেশবান্ধব উপাদান এবং প্রক্রিয়া ব্যবহার করে নতুন বাজার সৃষ্টি

  • ডিজাইন ও ফ্যাশন ট্রেন্ডের সাথে তাল মিলিয়ে চলা: আগ্রার শিল্প মৌসুমী এবং ফ্যাশন ট্রেন্ডের প্রতি দ্রুত সাড়া দেওয়ার জন্য পরিচিত

  • ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং: আগ্রার নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করে আন্তর্জাতিক বাজারে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি

মোজা ছাড়াই জুতা! আপনার পায়ের ত্বকের জন্য কত বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে, তা জানলে চমকে উঠবেন!

আগ্রার অন্যান্য শিল্প

যদিও পাদুকা শিল্প আগ্রার প্রধান পরিচয়, শহরটি অন্যান্য শিল্পের জন্যও পরিচিত:

  • মার্বেল এবং পাথরের কাজ

  • কার্পেট শিল্প

  • ডিজেল ইঞ্জিন উৎপাদন

  • কাচের শিল্প

  • ঢালাই শিল্প

তবে পাদুকা শিল্পই আগ্রার অর্থনীতির মেরুদণ্ড এবং শহরের প্রধান পরিচয়।

পর্যটন ও পাদুকা শিল্পের সংযোগ

তাজমহল দেখতে আসা লাখ লাখ পর্যটক আগ্রার স্থানীয় পাদুকা বাজার পরিদর্শন করেন এবং হস্তনির্মিত চামড়ার জুতা, চপ্পল ও অন্যান্য পণ্য কিনে নেন। এটি শুধুমাত্র স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে না, বরং আগ্রার পাদুকা শিল্পকে আন্তর্জাতিক পরিচিতি দেয়। পর্যটকদের জন্য তাজগঞ্জ, সদর বাজার এবং কিনারি বাজার বিশেষভাবে জনপ্রিয়।

আগ্রা শুধুমাত্র তাজমহলের শহর নয়, এটি ভারতের পাদুকা শিল্পের অবিসংবাদিত রাজধানী। মুঘল যুগের ঐতিহ্যবাহী কারিগরি দক্ষতা থেকে শুরু করে আধুনিক যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি পর্যন্ত, আগ্রা তার অনন্য পরিচয় ধরে রেখেছে। প্রায় ৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান, দেশের ৬৫% দেশীয় চাহিদা পূরণ এবং ২৮-৩৫% রপ্তানি অবদান সহ, আগ্রা ভারতের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যদিও শিল্পটি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, সরকারি সহায়তা, প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমবর্ধমান চাহিদা আগ্রার পাদুকা শিল্পের ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করে তুলছে। আগ্রার এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প শুধুমাত্র একটি অর্থনৈতিক কার্যক্রম নয়, এটি লাখো মানুষের জীবিকা এবং ভারতীয় সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

About Author
Ishita Ganguly

ঈশিতা গাঙ্গুলী ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি (IGNOU) থেকে স্নাতক। তিনি একজন উদ্যমী লেখক এবং সাংবাদিক, যিনি সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ ও অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে থাকেন। ঈশিতার লেখার ধরন স্পষ্ট, বস্তুনিষ্ঠ এবং তথ্যবহুল, যা পাঠকদের মুগ্ধ করে। তার নিবন্ধ ও প্রতিবেদনের মাধ্যমে তিনি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সামনে আনেন এবং পাঠকদের চিন্তা-চেতনার পরিসরকে বিস্তৃত করতে সহায়তা করেন। সাংবাদিকতার জগতে তার অটুট আগ্রহ ও নিষ্ঠা তাকে একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি দিয়েছে, যা তাকে ভবিষ্যতে আরও সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে।

আরও পড়ুন