ভারত-আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে চলমান আলোচনায় নতুন আশার সঞ্চার করেছেন কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পরেও আগামী নভেম্বরের মধ্যে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি (বিটিএ) সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
মঙ্গলবার মুম্বাইতে বার্ষিক গ্লোবাল ইনভেস্টর কনফারেন্স ২০২৫-এ ভার্চুয়াল বক্তব্যে গয়াল জানান, “আমি আশা করছি যে শীঘ্রই সবকিছু আবার ঠিকঠাক হয়ে যাবে এবং আমরা আগামী শরৎকালে, নভেম্বরের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করতে পারব। ফেব্রুয়ারিতে আমাদের দুই নেতার আলোচনা অনুযায়ী এই লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল”। একইসঙ্গে তিনি স্বীকার করেছেন যে আলোচনায় “একটু ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা বাণিজ্যিক বিষয়গুলোকে ছাপিয়ে গেছে”।
ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান এই বাণিজ্যিক টানাপোড়েনের মূল কারণ হলো ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত অভূতপূর্ব শুল্ক। গত ২৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হওয়া এই ৫০ শতাংশ শুল্ক ভারতীয় পণ্যের ওপর চাপানো হয়েছে। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ নিয়মিত শুল্ক এবং অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক রয়েছে, যা প্রধানত ভারতের রাশিয়ান তেল ক্রয়ের কারণে আরোপ করা হয়েছে।
এই শুল্ক ভারতের প্রধান রপ্তানি খাতগুলোতে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। বস্ত্র, গহনা, পাদুকা, প্লাস্টিক, রাসায়নিক পণ্য, চিংড়ি এবং কার্পেট শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে এই শুল্কের ফলে ভারতের মার্কিন রপ্তানি ২০২৪ সালের ৮৬.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৬ সালে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসতে পারে।
দুই দেশের বাণিজ্য আলোচনা শুরু হয়েছিল গত মার্চ মাসে এবং এ পর্যন্ত পাঁচটি দফা আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে। ২৫ আগস্ট থেকে ভারতে আসার কথা থাকা মার্কিন প্রতিনিধিদল ষষ্ঠ দফা আলোচনা স্থগিত করে দেয়। ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর এখনও পর্যন্ত নতুন কোনো আলোচনার তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি।
তবে রাজনৈতিক উত্তেজনার মাঝেও আশার আলো দেখা যাচ্ছে। মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, “দিনশেষে, দুটি মহান দেশ এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে। ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল গণতন্ত্র। তাদের মূল্যবোধ চীন বা রাশিয়ার চেয়ে আমাদের অনেক কাছের”।
পীযূষ গয়াল বেশ কয়েকবার জোর দিয়েছেন যে ভারত কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমার ভিত্তিতে বাণিজ্য চুক্তি করবে না। “ভারত কখনো সময়সীমার ভিত্তিতে বাণিজ্য চুক্তি করে না। যখন চুক্তিটি ভালো, পরিপূর্ণ এবং জাতীয় স্বার্থে হয়, তখনই আমরা তা গ্রহণ করি,” বলেছেন তিনি। কৃষি ও দুগ্ধ খাতে ভারত কোনো ধরনের ছাড় দিতে রাজি নয়, যা মার্কিন প্রশাসনের প্রধান দাবিগুলোর একটি।
ট্রাম্প সম্প্রতি দাবি করেছেন যে ভারত শূন্য শুল্কের প্রস্তাব দিয়েছে, তবে “এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে”। অপরদিকে ভারতীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে মার্কিন অতিরিক্ত শুল্ক প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করা কঠিন হবে।
দুই দেশের লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বর্তমান ১৯১ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা। এর প্রথম পর্যায়ের আলোচনা এই শরৎকালেই শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
গয়াল আরও জানিয়েছেন যে ভারত ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মরিশাস, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ফ্রি ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন (ইএফটিএ) ব্লকের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করেছে। একইসঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চিলি, পেরু এবং নিউজিল্যান্ডের সঙ্গেও আলোচনা চলমান রয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন যে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভারতের রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক এই বাণিজ্য আলোচনায় জটিলতা সৃষ্টি করছে। তবে দুই দেশের কৌশলগত অংশীদারিত্ব এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথ খোলা রয়েছে। আগামী নভেম্বরের মধ্যে এই চুক্তি সম্পন্ন হলে তা উভয় দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।