আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক এখন চরম উত্তেজনার মুখে। গত আগস্ট মাসে ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের উপর ৫০% পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছেন, যা ভারতের রপ্তানি খাতে গভীর সংকট সৃষ্টি করেছে। এই অভূতপূর্ব শুল্ক আরোপের পর ভারত সরকার এখন পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে, যা আমেরিকান পণ্যের উপর বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে।
ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের পেছনের কারণ
আমেরিকার এই কঠোর সিদ্ধান্তের মূল কারণ হলো ভারতের রাশিয়ার সাথে তেল ব্যবসা। ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনে পুতিনের যুদ্ধকে সমর্থন করছে। ৬ আগস্ট ২০২৫ তারিখে ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে ভারতীয় পণ্যের উপর অতিরিক্ত ২৫% শুল্ক আরোপ করেন, যা পূর্বের ২৫% শুল্কের সাথে মিলে মোট ৫০% হয়েছে।
এই শুল্কের হার চীন (৩০%), ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনের (২০%) তুলনায় অনেক বেশি। কেবল ব্রাজিল ভারতের মতো একই ৫০% শুল্কের মুখোমুখি হয়েছে।
কোন পণ্যগুলো ট্রাম্পের শুল্কের আওতায়
আমেরিকান শুল্কের আঘাতে ভারতের যেসব খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে:
মূল ক্ষতিগ্রস্ত খাতসমূহ:
- টেক্সটাইল ও পোশাক: ২৫% থেকে ৫০%
- রত্ন ও জুয়েলারি: ২৫% থেকে ৫০%
- চামড়া ও জুতা: ২৫% থেকে ৫০%
- সামুদ্রিক পণ্য: ৩৩.২৬% থেকে ৫৮.২৬%
- রাসায়নিক দ্রব্য: ২৫% থেকে ৫০%
- অটোমোবাইল ও যন্ত্রাংশ: ২৫% থেকে ৫০%
- ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম: ২৫% থেকে ৫০%
ইবনে সিনা হাসপাতাল টেস্ট লিস্ট ২০২৫: সম্পূর্ণ দাম ও বিস্তারিত তথ্য
অব্যাহতিপ্রাপ্ত খাতসমূহ:
সবচেয়ে বড় স্বস্তির বিষয় হলো, ভারতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি খাত এই শুল্কের আওতার বাইরে রয়েছে:
- ওষুধ শিল্প: ০% (আমেরিকান বাজারের ৫০% জেনেরিক ওষুধ ভারত থেকে আসে)
- ইলেকট্রনিক্স ও সেমিকন্ডাক্টর: ০%
- জ্বালানি পণ্য: ০%
- গুরুত্বপূর্ণ খনিজ: ০%
ভারতের অর্থনীতিতে প্রভাব
এই শুল্ক ভারতের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। ভারতের মোট রপ্তানির ৫৫% আমেরিকায় যায়, যার মূল্য ৮৭ বিলিয়ন ডলার। এটি ভারতের জিডিপির ২.৫% এর সমান।
অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ:
- জিডিপি প্রবৃদ্ধি: ০.২-০.৫% হ্রাস পেতে পারে
- ইঞ্জিনিয়ারিং রপ্তানি: ৪-৫ বিলিয়ন ডলার কমতে পারে
- ছোট ও মাঝারি শিল্প (MSME): বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে
- ভারতীয় টাকা: আন্তর্জাতিক বাজারে দুর্বল হয়েছে
মোদী সরকারের সম্ভাব্য জবাব
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই শুল্ক আরোপকে “অন্যায্য, অযৌক্তিক এবং অসমঙ্গত” বলে আখ্যায়িত করেছে। তবে ভারত তাৎক্ষণিক প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে কূটনৈতিক সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা করছে।
ভারতের কৌশলগত পদক্ষেপ:
- কূটনৈতিক আলোচনা: আমেরিকার সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় জোর দেওয়া
- বহুমুখী বাজার: রপ্তানির জন্য বিকল্প বাজার খোঁজা
- শিল্প সহায়তা: ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোকে সরকারি সহায়তা প্রদান
- আত্মনির্ভরতা: দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্ব
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই শুল্ক যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। ট্রাম্প ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে চীনের উপরও রাশিয়ার তেল আমদানির জন্য অনুরূপ শুল্ক আরোপ করা হতে পারে।
সমাধানের সম্ভাব্য পথ:
- ২১ দিনের গ্রেস পিরিয়ড: উভয় দেশের মধ্যে আলোচনার সুযোগ
- ট্রেড ডিল: আংশিক চুক্তির মাধ্যমে শুল্ক ১৫-২০% এ নামিয়ে আনা সম্ভব
- কৃষি ও ডেইরি খাত: কঠিন আলোচনার বিষয়
রুশ তেলের ‘জরিমানা’য় ভারতের বিপাকে ৫০% শুল্ক: মোকাবিলার তিন কৌশল নিয়ে দ্বিধায় নয়াদিল্লি
ভারতীয় ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া
এই শুল্ক আরোপের পর ভারতে আমেরিকান পণ্য বর্জনের ডাক উঠেছে। ম্যাকডোনাল্ড, কোকা-কোলা, অ্যামাজন, অ্যাপলের মতো আমেরিকান কোম্পানিগুলো বয়কটের মুখোমুখি হচ্ছে।
টেক্সটাইল এসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার রাকেশ মেহরা বলেছেন, এই শুল্ক ভারতীয় টেক্সটাইল রপ্তানিকারকদের জন্য “বিশাল ধাক্কা” এবং আমেরিকান বাজারে তাদের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ও উপসংহার
ট্রাম্প-মোদী বন্ধুত্বের যুগ শেষ হয়ে এখন দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা হয়েছে। এই অবস্থায় ভারতের জন্য সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে ধৈর্য ধারণ করে কূটনৈতিক সমাধানের পথ খোঁজা।
ভারত সরকার যদি পাল্টা শুল্ক আরোপ করে, তাহলে তা আমেরিকান ভোক্তাদের জন্য ক্ষতিকর হবে এবং বাণিজ্য ঘাটতি আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই বিশেষজ্ঞরা সুপারিশ করছেন যে ভারতের উচিত হবে নতুন বাজার খোঁজা, দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং রপ্তানি বহুমুখীকরণের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবেলা করা।