Subhanshu Shukla space mission: ভারতীয় বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্লা ইতিহাস রচনা করে ৪১ বছর পর দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে মহাকাশে পাড়ি জমিয়েছেন। গত বুধবার (২৫ জুন, ২০২৫) দুপুর ১২টা ১ মিনিটে নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে অ্যাক্সিয়ম-৪ মিশনের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (আইএসএস) উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন তিনি। এই মিশনটি কেবল ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং ভারতের মহাকাশ গবেষণা ও ভবিষ্যতের গগনযান মিশনের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
১৯৮৪ সালে রাকেশ শর্মার পর এই প্রথম কোনো ভারতীয় মহাকাশে গেলেন। স্পেসএক্স ফ্যালকন-৯ রকেটে করে ক্রু ড্রাগন মহাকাশযানে চেপে শুভাংশু শুক্লা ও তার সহযাত্রীরা পৃথিবী ছেড়ে আইএসএসের দিকে এগিয়ে চলেছেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে (ভারতীয় সময়) আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের সাথে ডকিং হওয়ার কথা রয়েছে তাদের।
অ্যাক্সিয়ম-৪ মিশনের পাইলট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শুভাংশু শুক্লা। এই চার সদস্যের দলে রয়েছেন কমান্ডার পেগি হুইটসন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), স্লাভোশ উজনানস্কি-উইসনিয়েভস্কি (পোল্যান্ড) এবং তিবোর কাপু (হাঙ্গেরি)। উল্লেখযোগ্য যে, পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরিও ৪০ বছরের বেশি সময় পর তাদের নাগরিকদের মহাকাশে পাঠাচ্ছে।
১৯৮৫ সালের ১০ অক্টোবর উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্ণৌতে জন্মগ্রহণকারী শুভাংশু শুক্লা ২০০৬ সালের জুন মাসে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ফাইটার উইংয়ে কমিশন লাভ করেন। একজন অভিজ্ঞ টেস্ট পাইলট হিসেবে তার রয়েছে ২০০০ ঘন্টার ফ্লাইট অভিজ্ঞতা, যার মধ্যে রয়েছে সু-৩০ এমকেআই, মিগ-২১, মিগ-২৯, জাগুয়ার, হক, ডর্নিয়ার এবং এএন-৩২ বিমানে উড্ডয়নের অভিজ্ঞতা। ২০২৪ সালের মার্চে তিনি গ্রুপ ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন।
ইসরোর পক্ষ থেকে ২০১৯ সালে শুভাংশু শুক্লাকে ভারতের গগনযান মিশনের জন্য নির্বাচিত করা হয়। এরপর তিনি রাশিয়ার স্টার সিটিতে অবস্থিত ইউরি গাগারিন কসমোনট ট্রেনিং সেন্টারে এক বছরের কঠোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ২০২৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাকে ভারতের গগনযান মিশনের জন্য নির্বাচিত চার নভোচারীর একজন হিসেবে ঘোষণা করেন।
এই মিশনের গুরুত্ব কেবল ব্যক্তিগত অর্জনেই সীমাবদ্ধ নেই। পুরো চৌদ্দ দিনের এই অভিযানে মোট ৬০টি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালিত হবে, যার মধ্যে সাতটি ভারতীয় গবেষকদের পরিকল্পিত। এর মধ্যে রয়েছে শূন্য মাধ্যাকর্ষণে মুগ ও মেথি চাষের পরীক্ষা, মহাকাশে জীবাণুর আচরণ পর্যবেক্ষণ, পেশির ক্ষয়, মানসিক স্বাস্থ্যের উপর স্ক্রিনের প্রভাব এবং কক্ষপথে মানব কোষের বার্ধক্য নিয়ে গবেষণা। এছাড়াও পুষ্টিকর মহাকাশ খাবার হিসেবে ভোজ্য শ্যাওলা চাষের সম্ভাবনা পরীক্ষা করা হবে।
লক্ষ্ণৌয়ের বাসিন্দারা তাদের এই কৃতী সন্তানের জন্য গর্বে ফেটে পড়েছেন। শহরের রাস্তায় রাস্তায় শুভাংশু শুক্লার ছবি সহ পোস্টার লাগানো হয়েছে। উৎক্ষেপণের দিন তার প্রাক্তন বিদ্যালয় সিটি মন্টেসরি স্কুলে লাইভ স্ট্রিমিং দেখানো হয়, যেখানে তার পিতা-মাতা উপস্থিত ছিলেন।
আবেগঘন মুহূর্তগুলি দেখা গেছে উৎক্ষেপণের সময়। শুভাংশুর মা আশা শুক্লা চোখে জল নিয়ে প্রার্থনা করতে করতে বড় পর্দায় তাকিয়ে ছিলেন, আর পাশে বসে তার বাবা শম্ভু দয়াল শুক্লা উত্তেজনায় হাসছিলেন। উৎক্ষেপণের সফলতার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আশা শুক্লা মিডিয়াকে বলেন, তিনি তার ছেলের জন্য সর্বোত্তম কামনা করেন। ঐতিহাসিক যাত্রার কয়েক ঘন্টা আগে শুভাংশু পরিবারকে বলেছিলেন, “শুধু আমার অপেক্ষায় থাকো, আমি ফিরে আসছি।”
ভারতীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী, যাত্রার আগে তার মা ভিডিও কলের মাধ্যমে তাকে দই-চিনি খাওয়ান, যা ভারতীয় পরিবারগুলিতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের আগে সৌভাগ্যের জন্য করা হয়। তার বাবা শম্ভু দয়াল শুক্লা গর্বের সাথে বলেন, “উপরওয়ালা যার রক্ষক, ভয় কিসের? ভগবান সবাইকে রক্ষা করেন।” তিনি আরও বলেন, “যারা কঠোর পরিশ্রম করে তারাই সফল হয়। কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই।”
এই মিশনটি ভারতের ভবিষ্যত মহাকাশ কর্মসূচির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৭ সালের প্রথম প্রান্তিকে ভারতের নিজস্ব গগনযান মিশন চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এই মিশনে তিনজন নভোচারীকে ৪০০ কিলোমিটার উচ্চতায় সাত দিনের জন্য পাঠানো হবে। শুভাংশু শুক্লার এই অভিজ্ঞতা ভারতের নিজস্ব মানববাহী মহাকাশ প্রকল্পের জন্য অমূল্য হবে।
প্রসঙ্গত, এই অ্যাক্সিয়ম-৪ মিশনটি ২০২৩ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় ভারত-মার্কিন যৌথ বিবৃতি থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এই চুক্তিতে ইসরো ও নাসার মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে একজন ভারতীয় নভোচারীকে আইএসএসে পাঠানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। মিশনটি কখনো কখনো “মিশন আকাশগঙ্গা” নামেও পরিচিত।
হিউস্টন ভিত্তিক বেসরকারি কোম্পানি অ্যাক্সিয়ম স্পেস এই মিশন পরিচালনা করছে নাসার সাথে অংশীদারিত্বে। এটি আইএসএসে চতুর্থ বেসরকারি নভোচারী মিশন। উৎক্ষেপণ স্থলটিও ঐতিহাসিক – কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চ কমপ্লেক্স ৩৯এ, যেখান থেকে ১৯৬৯ সালে নিল আর্মস্ট্রং অ্যাপোলো ১১ মিশনে চাঁদের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন।
শুভাংশু শুক্লার এই ঐতিহাসিক অভিযান শুধু ভারতের মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে না, বরং আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণাও হয়ে উঠবে। সারা দেশের ছাত্রছাত্রীরা যারা উৎক্ষেপণ দেখেছে, তারা হয়তো একদিন তাদের স্বপ্নও বাস্তবায়িত করতে পারবে। ১৪০ কোটি ভারতীয়ের আশা ও প্রত্যাশা নিয়ে শুভাংশু শুক্লা এখন মহাকাশে, আর তার এই যাত্রা ভারতের মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।