জাতীয় পতাকা ভাঁজ করার সঠিক নিয়ম: সম্মানের সাথে তিরঙ্গা সংরক্ষণের গোপন রহস্য

স্টাফ রিপোর্টার 7 Min Read

Indian flag folding rules: ভারতের জাতীয় পতাকা কেবল একটি কাপড়ের টুকরো নয় – এটি আমাদের গর্ব, সম্মান ও ঐতিহ্যের প্রতীক। কিন্তু অনেকেই জানেন না যে, জাতীয় পতাকা ভাঁজ করার ক্ষেত্রেও রয়েছে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন। ২০০২ সালের ফ্ল্যাগ কোড অব ইন্ডিয়া অনুযায়ী, তিরঙ্গাকে সঠিকভাবে ভাঁজ করে সংরক্ষণ করা প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। এই ব্লগে আমরা বিস্তারিতভাবে জানব কীভাবে যথাযথ সম্মানের সাথে আমাদের জাতীয় পতাকা ভাঁজ করতে হয় এবং কোন বিষয়গুলি মাথায় রাখতে হবে।

জাতীয় পতাকার গুরুত্ব ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

ভারতের ত্রিবর্ণ রঙিন পতাকা শুধু একটি জাতীয় প্রতীক নয়, এটি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও লক্ষ কোটি মানুষের স্বপ্নের প্রতিফলন। কেশরি রঙ সাহস ও ত্যাগের প্রতীক, সাদা রঙ শান্তি ও সত্যের প্রতিনিধি, আর সবুজ রঙ সমৃদ্ধি ও কৃষির প্রতীক। মাঝখানে থাকা অশোক চক্র আমাদের চিরন্তন অগ্রগতি ও ধর্মের শাশ্বত নিয়মের কথা মনে করিয়ে দেয়।

এই পবিত্র পতাকাকে যথাযথ সম্মানের সাথে পরিচালনা করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় নিয়মিতভাবে জনগণকে সচেতন করে থাকে যে পতাকার মর্যাদা রক্ষা করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

ফ্ল্যাগ কোড অব ইন্ডিয়া ২০০২: আইনি কাঠামো

২০০২ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া ফ্ল্যাগ কোড অব ইন্ডিয়া একটি সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামো যা জাতীয় পতাকার ব্যবহার, প্রদর্শন ও সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করে। এই কোডে তিনটি প্রধান অংশ রয়েছে:

  • প্রথম অংশ: পতাকার সাধারণ বিবরণ
  • দ্বিতীয় অংশ: নাগরিক, বেসরকারি সংস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য নিয়ম
  • তৃতীয় অংশ: সরকারি ও পাবলিক প্রতিষ্ঠানের জন্য নিয়ম

সাম্প্রতিক সংশোধনীর মাধ্যমে ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর পলিয়েস্টার কাপড়েরও অনুমতি দেওয়া হয়েছে, এবং ২০২২ সালের ২০ জুলাই থেকে রাত্রিকালীন প্রদর্শনেরও সুযোগ তৈরি হয়েছে।

জাতীয় পতাকা ভাঁজ করার সঠিক পদ্ধতি: ধাপে ধাপে নির্দেশিকা

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত নির্দেশিকা অনুযায়ী, জাতীয় পতাকা ভাঁজ করার জন্য চারটি সুনির্দিষ্ট ধাপ রয়েছে:

প্রথম ধাপ: পতাকাকে অনুভূমিকভাবে রাখা

জাতীয় পতাকা ভাঁজ করার শুরুতে পতাকাটিকে সম্পূর্ণ সমতল ও অনুভূমিক অবস্থানে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে কেশরি রঙ উপরে এবং সবুজ রঙ নিচে থাকবে, মাঝখানে সাদা অংশে অশোক চক্র দৃশ্যমান থাকবে।

দ্বিতীয় ধাপ: কেশরি ও সবুজ অংশ ভাঁজ করা

এরপর পতাকার উপরের কেশরি রঙের অংশ এবং নিচের সবুজ রঙের অংশ মাঝখানের সাদা অংশের নিচে ভাঁজ করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় সাদা অংশটি সবার উপরে থাকবে এবং কেশরি ও সবুজ অংশ ঢাকা পড়ে যাবে।

তৃতীয় ধাপ: সাদা অংশ ভাঁজ করা

তৃতীয় ধাপে সাদা অংশটিকে এমনভাবে ভাঁজ করতে হবে যেন শুধুমাত্র অশোক চক্রটি দৃশ্যমান থাকে। সাথে কেশরি ও সবুজ রঙের সামান্য অংশও দেখা যাবে। এই ভাঁজে অশোক চক্রের ২৪টি স্পোক স্পষ্টভাবে দেখা যাওয়া উচিত।

চতুর্থ ধাপ: নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ

সর্বশেষে এইভাবে ভাঁজ করা পতাকাটিকে দুই হাতের তালুতে অথবা বাহুতে নিয়ে একটি নিরাপদ ও সম্মানজনক স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে।

৪০ বছর পর মহাকাশে ভারতীয় পতাকা: আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে যাচ্ছেন শুভাংশু শুক্লা

পতাকা সংরক্ষণের সময় মনে রাখার বিষয়

উপযুক্ত উপকরণ নির্বাচন

ফ্ল্যাগ কোড অনুযায়ী, জাতীয় পতাকা তৈরির জন্য খাদি, তুলা, রেশম, পশম বা পলিয়েস্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। হাতে বোনা বা মেশিনে তৈরি উভয় ধরনের পতাকাই গ্রহণযোগ্য।

পতাকার অনুপাত রক্ষা করা

জাতীয় পতাকার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত অবশ্যই ৩:২ হতে হবে। এই অনুপাত রক্ষা না করলে তা আইন বিরোধী বলে বিবেচিত হবে।

ক্ষতিগ্রস্ত পতাকার ব্যবহার নিষেধ

কোনো পতাকা ছিঁড়ে গেলে, নোংরা হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা প্রদর্শন করা সম্পূর্ণ নিষিধ। এ ধরনের পতাকা একান্তে পোড়ানোর মাধ্যমে সম্মানজনকভাবে ধ্বংস করতে হবে।

যা করা উচিত: পতাকা পরিচালনার সঠিক নিয়ম

জাতীয় পতাকা ভাঁজ করার ক্ষেত্রে এবং সাধারণভাবে পতাকা পরিচালনার সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলি অবশ্যই মেনে চলতে হবে:

  • পতাকা উত্তোলনের সময় দ্রুত টানতে হবে এবং নামানোর সময় ধীরে ধীরে সম্মানের সাথে নামাতে হবে
  • অনুভূমিক প্রদর্শনের সময় কেশরি রঙ সর্বদা উপরে থাকবে
  • উল্লম্ব প্রদর্শনের সময় কেশরি রঙ দর্শকের বাম দিকে (পতাকার ডান দিকে) থাকবে
  • পতাকাকে সর্বদা সম্মানের স্থানে রাখতে হবে
  • পতাকা পরিষ্কার ও অক্ষত অবস্থায় থাকতে হবে

যা করা উচিত নয়: গুরুতর ভুলগুলি এড়িয়ে চলুন

ফ্ল্যাগ কোডে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে নিম্নলিখিত কাজগুলি করা সম্পূর্ণ নিষিধ:

  • পতাকাকে উল্টো করে প্রদর্শন করা (কেশরি রঙ নিচে থাকা)
  • পতাকাকে মাটি, পানি বা কোনো তলের সাথে স্পর্শ করানো
  • পতাকাকে গাড়ি, ট্রেন বা নৌকার উপর ঢাকা হিসেবে ব্যবহার করা
  • পতাকার উপর কোনো লেখা, ছবি বা নকশা আঁকা
  • পতাকাকে টেবিল ক্লথ, রুমাল বা অন্য কোনো ব্যবহারিক কাজে লাগানো
  • পতাকাকে পোশাক হিসেবে কোমরের নিচে পরিধান করা
  • অন্য কোনো পতাকাকে জাতীয় পতাকার চেয়ে উঁচুতে রাখা

রাত্রিকালীন প্রদর্শন: নতুন সুবিধা

২০২২ সালের ২০ জুলাই সংশোধনীর মাধ্যমে এখন জাতীয় পতাকা রাত্রিকালেও প্রদর্শন করা যায়, তবে শর্ত হল যে এর জন্য পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। এর আগে পতাকা শুধুমাত্র সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রদর্শন করা যেত।

স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলনে লালকেল্লা স্থানটিই বেছে নিয়েছিলেন নেহরু?

আইনি দায় ও শাস্তির বিধান

জাতীয় পতাকার অসম্মান বা ভুল ব্যবহারের জন্য ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড, জরিমানা অথবা উভয় শাস্তির বিধান রয়েছে। পতাকা পোড়ানো বা বিকৃত করা একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।

সামাজিক দায়বদ্ধতা ও শিক্ষার ভূমিকা

প্রতিটি নাগরিকের উচিত পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও সমাজের অন্যদের জাতীয় পতাকা ভাঁজ করার সঠিক নিয়ম সম্পর্কে অবগত করানো। বিশেষ করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ‘হর ঘর তিরঙ্গা’ অভিযানের মাধ্যমে সরকার প্রতিটি ঘরে জাতীয় পতাকা উড়ানোর জন্য উৎসাহিত করছে। এই উদ্যোগের সাফল্যের জন্য পতাকার সঠিক ব্যবহার ও সংরক্ষণ সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা অপরিহার্য।

জাতীয় পতাকা কেবল একটি প্রতীক নয়, এটি আমাদের জাতীয় চেতনা ও গৌরবের মূর্ত প্রকাশ। জাতীয় পতাকা ভাঁজ করার ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম মেনে চলা আমাদের দেশপ্রেম ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অংশ। ফ্ল্যাগ কোড অব ইন্ডিয়া অনুসরণ করে আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে আমাদের তিরঙ্গা সর্বদা যোগ্য সম্মান ও মর্যাদা পেয়ে থাকে। প্রতিটি নাগরিকের এই দায়িত্ব রয়েছে যে, তারা নিজেরা সঠিক নিয়ম জানবে এবং অন্যদেরও শেখাবে। এভাবেই আমরা আমাদের জাতীয় পতাকার মর্যাদা রক্ষা করতে পারি এবং আমাদের দেশের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারি।

Share This Article