Shubhangshu Shukla ISS mission: ১৯৮৪ সালে রাকেশ শর্মার ঐতিহাসিক মহাকাশ অভিযানের চার দশক পর, ভারত আবারও মহাকাশে একজন দেশের প্রতিনিধি পাঠাতে চলেছে। ভারতীয় বায়ুসেনার গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্লা আগামী মে মাসে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (International Space Station – ISS) যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। অ্যাক্সিওম স্পেস (Axiom Space) এর Ax-4 মিশনের অংশ হিসেবে তিনি মহাকাশে পাড়ি জমাবেন, যা ভারতের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করবে।
শুভাংশু শুক্লা: ভারতের নতুন মহাকাশচারী
শুভাংশু শুক্লা, যিনি ১০ অক্টোবর ১৯৮৫ সালে উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পুণের ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমি (NDA) থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং ২০০৬ সালের জুন মাসে ভারতীয় বায়ুসেনার ফাইটার উইংয়ে যোগদান করেন1। মার্চ ২০২৪-এ তিনি গ্রুপ ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন।
শুক্লা একজন অভিজ্ঞ টেস্ট পাইলট হিসাবে ২,০০০ ঘণ্টারও বেশি উড়ান অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি Su-30 MKI, MiG-21, MiG-29, Jaguar, Hawk, Dornier এবং An-32 সহ বিভিন্ন বিমান চালিয়েছেন। তাঁর এই বিশাল অভিজ্ঞতা তাকে মহাকাশযাত্রার জন্য আদর্শ প্রার্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
২০১৯ সালে, ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ISRO) তাকে মহাকাশচারী প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত করে। এরপর তিনি রাশিয়ার স্টার সিটিতে অবস্থিত ইউরি গাগারিন কসমোনট ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ নেন। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, তিনি ভারতের প্রথম মানবযুক্ত মহাকাশ অভিযান গগনযান মিশনের জন্য প্রধান মহাকাশচারী হিসাবে নির্বাচিত হন।
ঐতিহাসিক Ax-4 মিশন: বিবরণ ও গুরুত্ব
Ax-4 মিশন, যেটি NASA এবং Axiom Space নামক একটি বেসরকারি কোম্পানির মধ্যে সহযোগিতার ফল, মে ২০২৫-এ শুরু হবে। এই মিশনে শুভাংশু শুক্লা প্রাক্তন NASA মহাকাশচারী পেগি হুইটসন, পোল্যান্ডের স্লাওশ উজনানস্কি-উইসনিয়েউস্কি এবং হাঙ্গেরির তিবোর কাপু-এর সাথে যুক্ত হবেন।
মিশনের মোট সময়কাল হবে ১৪ দিন, যা দরমিয়ান শুক্লা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনা করবেন। এই মিশনটি শুভাংশু শুক্লাকে শুধু ভারতের প্রথম ISS-ভিজিটর করবে না, বরং এটি পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির প্রথম মহাকাশচারীদেরও ISS-এ আনবে।
“আমাদের চেষ্টা হবে এই মিশনটি সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সাথে সম্পাদন করা। আমি আশা করি আমার এই অভিযান আমার দেশের একটি পূর্ণ প্রজন্মের মধ্যে কৌতূহল জাগাবে এবং ভবিষ্যতে এরকম আরও অনেক মিশন সম্ভব করার জন্য উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে,” একটি অনলাইন সাংবাদিক সম্মেলনে শুক্লা বলেছেন।
ISS-এ পরিচালিত হবে সাতটি গবেষণা
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে তাঁর ১৪ দিনের অবস্থানকালে, শুভাংশু শুক্লা অন্তত সাতটি পরীক্ষা পরিচালনা করবেন। এর মধ্যে মহাকাশে ফসল উৎপাদন এবং “ওয়াটার বেয়ারস” বা টার্ডিগ্রেড নামক জীবের অধ্যয়ন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
টার্ডিগ্রেডস হল ছোট প্রাণী যারা প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীতে বাস করছে এবং চরম পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার জন্য পরিচিত। এই গবেষণায় মহাকাশে পাঠানো টার্ডিগ্রেড এবং পৃথিবীতে রাখা নিয়ন্ত্রিত নমুনার মধ্যে জিন প্রকাশের প্যাটার্ন তুলনা করা হবে।
এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা জৈবপ্রযুক্তিতে উন্নতি আনতে এবং ভবিষ্যতের মহাকাশ ভ্রমণ সম্পর্কে আরও তথ্য প্রদান করতে পারে বলে Axiom Space জানিয়েছে।
রাকেশ শর্মার ঐতিহাসিক অভিযানের ৪০ বছর পর
শুভাংশু শুক্লার এই যাত্রা স্কোয়াড্রন লিডার রাকেশ শর্মার ঐতিহাসিক মহাকাশ অভিযানের ঠিক ৪০ বছর পরে হতে চলেছে। ৩ এপ্রিল, ১৯৮৪ সালে, শর্মা সোয়েত সোয়ুজ T-11 রকেটে চড়ে মহাকাশে যান এবং সোভিয়েত সালুট-7 স্পেস স্টেশনে পৌঁছান।
রাকেশ শর্মা কসমোনট ইউরি মালিশেভ এবং জেনাদি স্ট্রেকালভের সাথে মিলে তৎকালীন সোভিয়েত কাজাখস্তানের বাইকোনুর কসমোড্রোম থেকে উৎক্ষেপিত হন। ১৬ ঘণ্টার চেজের পর, তাদের স্পেসক্র্যাফট সোভিয়েত সালুট স্টেশনের সাথে ডক করে এবং মহাকাশচারীরা পরবর্তী সাত দিনের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ মিশন শুরু করেন।
শর্মা মহাকাশে প্রতিদিন ১০ মিনিট যোগব্যায়াম করে তার কার্যকারিতা পরীক্ষা করেন। তিনি তার বুক, ঘাড় এবং উরুতে ইলেকট্রোড লাগিয়ে শূন্য মাধ্যাকর্ষণের হৃদয়ের উপর প্রভাব অনুসন্ধান করেন।
ভারতের মহাকাশ অভিযানে নতুন যুগের সূচনা
শুভাংশু শুক্লার আসন্ন মহাকাশ অভিযান ভারতের মহাকাশ প্রোগ্রামের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি শুধু একটি প্রতীকী যাত্রা নয়, বরং ভারতের বিস্তৃত আন্তর্জাতিক মহাকাশ সহযোগিতার একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
মহাকাশ বিভাগের মন্ত্রী ডঃ জিতেন্দ্র সিং এই অভিযানের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেছেন, “ভারত তার মহাকাশ যাত্রায় একটি নির্ণায়ক অধ্যায় রচনা করতে প্রস্তুত। একজন ভারতীয় মহাকাশচারী একটি ঐতিহাসিক মহাকাশ অভিযানের জন্য প্রস্তুত যেমন ISRO সাহসী নতুন সীমানা চিহ্নিত করছে। গগনযান প্রস্তুতি, ISS মিশন এবং উৎক্ষেপণের গ্রীষ্মকাল দিয়ে ভারতের মহাকাশ স্বপ্ন উচ্চতর উড়ানে উঠছে।”
মহাকাশচারী প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি
শুভাংশু শুক্লা Ax-4 মিশনের জন্য প্রস্তুতি হিসাবে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। একজন ভারতীয় বায়ুসেনা পাইলট হিসাবে তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা তাকে মহাকাশে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত প্রার্থী করে তুলেছে।
তিনি যোগ ও ব্যায়ামের মাধ্যমে শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখছেন এবং শূন্য মাধ্যাকর্ষণে কাজ করার জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। স্পেসক্র্যাফট অপারেশন, সিস্টেম চেকিং এবং জরুরি পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে তাকে ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
শুক্লার এই যাত্রা, যা মে ২০২৫-এ শুরু হবে, ভারতের গগনযান মিশনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা প্রদান করবে, যা ২০২৬ সালে উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
ভারতের মহাকাশ এজেন্ডার একটি গৌরবময় গ্রীষ্মকাল
শুভাংশু শুক্লার ISS অভিযান ভারতের মহাকাশ কর্মসূচির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য গ্রীষ্মকালের শুরু মাত্র। এই অভিযানের পর, জুন মাসে ISRO বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পৃথিবী পর্যবেক্ষণ উপগ্রহ NISAR (NASA-ISRO Synthetic Aperture Radar) উৎক্ষেপণ করবে।
$1.5 বিলিয়ন মূল্যের এই উপগ্রহ ISRO ও NASA-এর একটি যৌথ মিশন এবং এটি ভারতীয় মাটি থেকে GSLV Mk II রকেটে উৎক্ষেপিত হবে। NISAR গ্লেসিয়ার গলা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ভূমিকম্প এবং ভূমিধস সহ পৃথিবীর পরিবর্তন ট্র্যাক করবে।
এটি NASA থেকে L-ব্যান্ড এবং ISRO থেকে S-ব্যান্ড রাডার ব্যবহার করে পৃথিবীর পৃষ্ঠের পরিবর্তন সেন্টিমিটারেরও কম নির্ভুলতার সাথে ধারণ করবে।
শুভাংশু শুক্লার আসন্ন অভিযান ভারতের মহাকাশ ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত চিহ্নিত করবে। রাকেশ শর্মার ঐতিহাসিক অভিযানের চার দশক পর, ভারত আবার একবার মহাকাশে তার পতাকা উড়াবে, এবারে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে।
এই মিশন শুধু ভারতের মহাকাশ প্রযুক্তিতে অগ্রগতিই প্রদর্শন করবে না, বরং আন্তর্জাতিক মহাকাশ সম্প্রদায়ের সাথে ভারতের বর্ধমান সংযোগও প্রতিফলিত করবে। Axiom-4 মিশনে শুক্লার অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক মহাকাশ অন্বেষণে সক্রিয় অংশীদার হিসাবে ভারতের স্থানকে আরও সুদৃঢ় করবে।
মহাকাশে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হওয়ার সময়, শুভাংশু শুক্লা শুধু একজন মহাকাশচারী হিসাবেই নয়, বরং ভারতের মহাকাশ আকাঙ্ক্ষার একজন প্রতিনিধি হিসাবেও কাজ করবেন। তাঁর অভিযান ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং ভারতের মহাকাশ কর্মসূচির জন্য নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে।