ভারতের মোট জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে ‘জেন-জি’ (Gen-Z) বা ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া তরুণ-তরুণীরা। প্রায়শই বলা হয়, ভারত এক অভূতপূর্ব ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-এর সুবর্ণ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে কর্মক্ষম তরুণের সংখ্যা প্রবীণদের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু একটি অদ্ভুত বৈপরীত্য লক্ষ্যণীয়। যখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, তা নেপালের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন হোক বা মরক্কোর সামাজিক দাবিতে আন্দোলন (AP News অনুযায়ী), জেন-জি’র তরুণরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের ঝড় তুলছে, তখন ভারতে তুলনামূলকভাবে সেই চিত্র অনেকটাই নীরব। এই নীরবতার কারণ কি শুধুই উদাসীনতা? নাকি ভারতীয় জেন-জি এক গভীরতর অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, যা তাদের প্রতিবাদের ধরণকেই আমূল বদলে দিয়েছে? এই প্রবন্ধে আমরা সেই জটিল সমীকরণের গভীরে প্রবেশ করব, তথ্য ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বোঝার চেষ্টা করব কেন ভারতের এই ‘ডিজিটাল জেনারেশন’ রাস্তার চেয়ে পর্দার আড়ালে তাদের লড়াই লড়তে বেশি স্বচ্ছন্দ।
জেন-জি কারা এবং ভারতীয় প্রেক্ষাপট
‘জেন-জি’ (Generation Z) বলতে সেই প্রজন্মকে বোঝানো হয়, যারা আক্ষরিক অর্থেই ডিজিটাল যুগে জন্মগ্রহণ করেছে। ইন্টারনেট, স্মার্টফোন এবং সোশ্যাল মিডিয়া তাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভারতের জন্য এই প্রজন্মটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (UNFPA)-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারত বর্তমানে বিশ্বের সর্বাধিক তরুণ জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশ। ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ২৬% হলেন ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী, যা এক বিশাল কর্মক্ষম শক্তির ভাণ্ডার।
এই প্রজন্মটি তাদের পূর্ববর্তী ‘মিলেনিয়াল’ (Millennials) প্রজন্মের থেকে অনেকটাই আলাদা। তারা প্রযুক্তিগতভাবে শুধু দক্ষই নয়, বিশ্বব্যাপী তথ্যের অবাধ প্রবাহে তারা অনেক বেশি সচেতন। তারা সামাজিক ন্যায়বিচার, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক বেশি সোচ্চার। কিন্তু এই সচেতনতা সত্ত্বেও, চিরাচরিত পথে, অর্থাৎ রাস্তায় নেমে, ব্যানার হাতে নিয়ে, স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে ভারতীয় জেন-জি-কে তুলনামূলকভাবে কম সক্রিয় দেখা যায়। যেখানে তাদের সমসাময়িকরা পেরু থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে (AP News, 2025) শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামছে, সেখানে ভারতীয় তরুণদের এই আপাত ‘নিষ্ক্রিয়তা’ অনেক সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কপালে ভাঁজ ফেলেছে।
বৈশ্বিক প্রতিবাদের ঝড় বনাম ভারতীয় নীরবতা
২০২৪ এবং ২০২৫ সাল বিশ্বজুড়ে তরুণদের নেতৃত্বে একাধিক গণ-আন্দোলনের সাক্ষী থেকেছে। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (AP) রিপোর্ট করেছে যে, মরক্কোতে ‘জেন-জি ২১২’ নামক একটি নেতৃত্বহীন গোষ্ঠী উন্নত জনপরিষেবার দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। নেপালে তরুণদের নেতৃত্বে এক মারাত্মক অভ্যুত্থান সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগে বাধ্য করে। এই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ভারতকে একটি ব্যতিক্রম বলে মনে হয়। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে যে ভারতীয় জেন-জি প্রতিবাদ করছে না তা নয়, বরং তাদের প্রতিবাদের ধরণ এবং ক্ষেত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
প্রতিবাদের অনুপস্থিতি? নাকি রূপান্তর?
মূল প্রশ্নটি হলো: ভারতীয় তরুণরা কি সত্যিই প্রতিবাদবিমুখ হয়ে পড়েছে? তথ্য কিন্তু তা বলছে না। বরং বলা ভালো, তাদের প্রতিবাদের ‘ভাষা’ এবং ‘মাঠ’ বদলে গেছে। চিরাচরিত রাস্তার লড়াইয়ের পরিবর্তে, তাদের রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে ডিজিটাল দুনিয়া।
ডিজিটাল অ্যাক্টিভিজম: নতুন রণক্ষেত্র
ভারত এক ডিজিটাল বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ২০২৩ সালেই ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮২ কোটি ছাড়িয়েছে (Dhaka Mail) এবং ২০২৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৯০০ মিলিয়ন অতিক্রম করবে বলে আশা করা হচ্ছে, যার মধ্যে গ্রামীণ ভারতেই ব্যবহারকারী ৪৮৮ মিলিয়ন (Dainik Statesman)। জেন-জি এই ডিজিটাল ভারতের প্রধান চালিকাশক্তি। তাদের কাছে স্মার্টফোন হলো প্রতিবাদের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।
হ্যাশট্যাগ (#) আন্দোলন: একটি নির্দিষ্ট হ্যাশট্যাগকে ট্রেন্ডিং করে তোলা এখন প্রতিবাদের অন্যতম প্রধান রূপ। তা সে কোনো সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে হোক বা পরিবেশগত কোনো ইস্যু।
অনলাইন পিটিশন: Change.org-এর মতো প্ল্যাটফর্মে লক্ষ লক্ষ সই সংগ্রহ করে নীতি নির্ধারকদের উপর চাপ সৃষ্টি করা এখন একটি সাধারণ ঘটনা।
সোশ্যাল মিডিয়া কল-আউট: কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি, সংস্থা বা এমনকি সরকারী দফতরের অন্যায্য কাজের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরাসরি সোচ্চার হওয়া (Call-out culture) ভারতীয় জেন-জি’র মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
কার্নেগি এন্ডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস (Carnegie Endowment for International Peace)-এর একটি বিশ্লেষণে (সেপ্টেম্বর ২০২৫) এশিয়াজুড়ে সোশ্যাল মিডিয়া-জ্বালানিযুক্ত জেন-জি প্রতিবাদগুলির উত্থান-পতন বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়া তরুণদের “অন্যায়-অবিচারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে” এবং সেগুলিকে “বৃহত্তর আর্থ-সামাজিক কাঠামোর সাথে সংযুক্ত করতে” সাহায্য করে। এটি আন্দোলনকে দ্রুত সংগঠিত করতে পারে।
“স্ল্যাক্টিভিজম” বনাম বাস্তব পরিবর্তন
এই ডিজিটাল অ্যাক্টিভিজমকে প্রায়শই সমালোচকরা ‘স্ল্যাক্টিভিজম’ (Slacktivism) বা ‘অলস প্রতিবাদ’ বলে অভিহিত করেন। সমালোচকদের মতে, একটি লাইক, শেয়ার বা কমেন্ট করা খুব সহজ এবং এতে কোনো ব্যক্তিগত ঝুঁকি নেই। এটি রাস্তায় নামার মতো বাস্তব রাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে পারে না।
কিন্তু এই ধারণাটিও পুরোপুরি সঠিক নয়। ডিজিটাল প্রতিবাদ অনেক সময়ই বাস্তব জগতে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। স্থানীয় স্তরের বিভিন্ন সমস্যা, যা হয়তো মূলধারার মিডিয়াতে জায়গা পায় না, তা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারের আলোয় এসেছে এবং প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করেছে। IASbaba-এর একটি ইউটিউব বিশ্লেষণ (সেপ্টেম্বর ২০২৫) উল্লেখ করেছে যে, লাদাখ বা কর্ণাটকের ধারওয়াদের মতো জায়গায় তরুণদের প্রতিবাদ দেখা গেছে, যা প্রমাণ করে যে তারা পর্দা থেকে রাস্তায় পা রাখতেও সক্ষম, যদিও তা দেশব্যাপী নয়, বরং স্থানীয় ও নির্দিষ্ট ইস্যুভিত্তিক।
তবে, কার্নেগি এন্ডোমেন্টের বিশ্লেষণটি এই ডিজিটাল প্রতিবাদের দুর্বলতার দিকটিও তুলে ধরে। এই আন্দোলনগুলি প্রায়শই “নেতৃত্বহীন” হয়, যা তাদের নমনীয় করলেও দীর্ঘমেয়াদী সাংগঠনিক কাঠামোর অভাব তৈরি করে। এটি আন্দোলনকে “বিভক্ত” (fragmented) করে তোলে এবং রাষ্ট্রীয় “ডিজিটাল দমন” (digital repression)-এর সামনে آسیبپذیر (vulnerable) করে তোলে।
কেন রাস্তা নীরব? মূল কারণগুলির বিশ্লেষণ
যদি ডিজিটাল অ্যাক্টিভিজম একটি কারণ হয়, তবে রাস্তার নীরবতার পেছনে আরও গভীর, কাঠামোগত কিছু কারণও রয়েছে। এই কারণগুলি ভারতীয় জেন-জি’র বাস্তব জীবনের অগ্রাধিকার এবং ভয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
অর্থনৈতিক চাপ: ‘ক্যারিয়ার’ বনাম ‘আন্দোলন’
ভারতীয় জেন-জি’র সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি রাজনৈতিক নয়, বরং অর্থনৈতিক। তারা এমন এক সময়ে বড় হয়েছে যখন চাকরির বাজার অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা চরমে।
বেকারত্বের উচ্চ হার: আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) এবং ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (IHD)-এর ‘ইন্ডিয়ান এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট ২০২৪’ অনুযায়ী, ভারতের বেকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৮০ শতাংশেরও বেশি হলো যুবক (Ei Samay)। এটি একটি ভয়াবহ পরিসংখ্যান।
জীবনযাত্রার ব্যয়: ডেলয়েট-এর ‘জেন-জি অ্যান্ড মিলেনিয়াল সার্ভে ২০২৪’ (Deloitte 2024 Survey) অনুসারে, জেন-জি’র জন্য জীবনযাত্রার ব্যয় (cost of living) হলো তাদের প্রধান উদ্বেগের কারণ। এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারতের প্রায় ৫৬% জেন-জি ‘পে-চেক টু পে-চেক’ (paycheck-to-paycheck) জীবনযাপন করে, অর্থাৎ মাসের বেতন মাসেই শেষ হয়ে যায়, কোনো সঞ্চয় থাকে না।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (The Business Standard)-এর একটি বিশ্লেষণে (অক্টোবর ২০২৫) স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, “অর্থনৈতিক উদ্বেগ প্রায়শই প্রতিবাদের তাগিদকে ছাপিয়ে যায়।” যখন একজন তরুণের প্রধান লক্ষ্য একটি স্থিতিশীল চাকরি জোগাড় করা এবং পরিবারের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা, তখন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে অংশ নেওয়া, যা তার ক্যারিয়ারের সম্ভাবনাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে, তা একটি বিলাসিতা মাত্র। তারা “চাকরির সম্ভাবনাকে বিপন্ন করতে অনিচ্ছুক।”
রাজনৈতিক জলবায়ু এবং ‘নজরদারি’র ভয়
অর্থনৈতিক চাপের পাশাপাশি, বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশও তরুণদের রাস্তায় নামার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধক। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (TBS) এই বিষয়টিকে “রাজনৈতিক বাধার জলবায়ু” (climate of political deterrence) বলে অভিহিত করেছে।
তরুণদের মধ্যে “রাষ্ট্র-বিরোধী” বা “অ্যান্টি-ন্যাশনাল” হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার ভয় তীব্র। বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, “এমনকি সবচেয়ে সচেতন তরুণরাও ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ তকমা পাওয়ার ভয়ে রাস্তায় নামতে দ্বিধা বোধ করে।” এই ভয় অমূলক নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, বিভিন্ন প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারী ছাত্র এবং অ্যাক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন (যেমন UAPA) প্রয়োগের উদাহরণ দেখা গেছে।
এমনকি প্রতিবাদের ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রস্থল—ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির—রাজনৈতিক পরিসরও সংকুচিত হয়েছে (TBS, 2025)। ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক আলোচনা বা সমাবেশের উপর ক্রমবর্ধমান বিধিনিষেধ তরুণদের সংগঠিত হওয়ার পথকে রুদ্ধ করেছে। এই “প্রাতিষ্ঠানিক বিধিনিষেধ” (institutional restrictions) এবং “দমনের সংস্কৃতি” (culture of deterrence) সম্মিলিতভাবে একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে, যা জেন-জি’কে রাস্তা থেকে দূরে রাখছে।
মানসিক স্বাস্থ্যের সংকট: ‘উদ্বিগ্ন প্রজন্ম’ (The Anxious Generation)
জেন-জি হলো এমন একটি প্রজন্ম যারা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সবচেয়ে বেশি খোলামেলা, কারণ তারা এই সমস্যায় সবচেয়ে বেশি জর্জরিত।
ডেলয়েট-এর ২০২৪ সালের সমীক্ষা (Deloitte 2024 Survey) অনুযায়ী, ভারতের ৪০% জেন-জি “প্রায় সব সময় বা বেশিরভাগ সময়” মানসিক চাপ বা উদ্বেগে ভোগে। তাদের এই চাপের প্রধান কারণ হলো—তাদের ভবিষ্যৎ (finances) এবং পরিবারের স্বাস্থ্য ও কল্যাণ।
ভারত সরকারের নিজস্ব অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৪-২৫ (Economic Survey 2024-25) এই বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছে। প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো (PIB) দ্বারা প্রকাশিত সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে যে, “তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যই ভবিষ্যৎ অর্থনীতিকে চালিত করবে।” সমীক্ষাটি “ইন্টারনেট এবং বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহারের” সাথে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সংযোগের দিকে ইঙ্গিত করেছে, যা জোনাথন হাইডটের বই ‘দ্য অ্যাংজিয়াস জেনারেশন’-এর প্রতিধ্বনি করে।
যখন একটি প্রজন্ম তাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন, সামাজিক মিডিয়া দ্বারা ক্রমাগত চাপের মধ্যে রয়েছে এবং একটি গভীর মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের সাথে লড়াই করছে, তখন তাদের পক্ষে শারীরিক শক্তি এবং মানসিক দৃঢ়তা ব্যয় করে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ সংগঠিত করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
পরিচয়ের বিভাজন
ভারত একটি বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় দেশ। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (TBS) উল্লেখ করেছে যে, “গভীর সামাজিক বিভাজন” (deep social fragmentation) এবং “ক্রোধের বিকেন্দ্রীকরণ” (decentralisation of anger) একটি দেশব্যাপী, একীভূত যুব আন্দোলন গড়ে তোলার পথে প্রধান বাধা।
তরুণদের উদ্বেগগুলি এক নয়। উত্তর-পূর্বের একজন তরুণের অগ্রাধিকার হয়তো পরিবেশগত এবং জাতিগত অধিকার, যেখানে দক্ষিণ ভারতের একজন তরুণের প্রধান চিন্তা হয়তো ভাষার আধিপত্য বা অর্থনৈতিক বৈষম্য। এই বিভাজনের ফলে কোনো একটি নির্দিষ্ট ইস্যুতে সমগ্র ভারতীয় জেন-জি’কে এক ছাতার তলায় আনা প্রায় অসম্ভব। তাদের প্রতিবাদগুলি স্থানীয় এবং ইস্যুভিত্তিক (যেমন লাদাখ বা ধারওয়াদ) থাকছে, কিন্তু তা জাতীয় রূপ পাচ্ছে না।
তরুণদের অগ্রাধিকার: লোকনীতি-সিএসডিএস কী বলছে?
তরুণরা যে রাজনৈতিকভাবে উদাসীন নয়, তার প্রমাণ মেলে লোকনীতি-সিএসডিএস (Lokniti-CSDS)-এর ‘ইয়ুথ অ্যান্ড পলিটিক্স সার্ভে ২০২৪’ (Youth and Politics Survey 2024) -এর তথ্যে। এই সমীক্ষাটি ভারতীয় তরুণদের বাস্তব উদ্বেগের একটি পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরে।
যখন তরুণদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তারা সরকারের কোন কাজে সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট, তখন শীর্ষ তিনটি উত্তর ছিল:
| সরকারের প্রতি অসন্তোষের কারণ | শতাংশ (Lokniti-CSDS 2024) |
| সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি (Communalism has increased) | ১৭.৪% |
| মূল্যবৃদ্ধি (Price rise) | ১৪.৭% |
| বেকারত্ব বৃদ্ধি (Increasing unemployment) | ১১.৭% |
এই ডেটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি দেখায় যে ভারতীয় তরুণরা বিমূর্ত রাজনৈতিক আদর্শের চেয়ে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে এমন বিষয়গুলি নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত। বেকারত্ব এবং মূল্যবৃদ্ধি—এই দুটিই সরাসরি তাদের অর্থনৈতিক অস্তিত্বের সাথে জড়িত, যা ডেলয়েট এবং আইএলও-এর রিপোর্টকে সমর্থন করে। একই সাথে, সাম্প্রদায়িকতার বৃদ্ধি নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রমাণ করে যে তারা সামাজিক সম্প্রীতি এবং ন্যায়বিচার নিয়েও সচেতন।
তারা প্রতিবাদবিমুখ নয়; তাদের প্রতিবাদের অগ্রাধিকারগুলি ভিন্ন। তারা এমন একটি সিস্টেমের সাথে লড়াই করছে যেখানে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা এবং সামাজিক বিভাজন তাদের প্রধান শত্রু।
এক নীরব, কিন্তু সতর্ক প্রজন্ম
তাহলে, ভারতীয় জেন-জি’র উত্থান কি ব্যর্থ হয়েছে? তারা কি রাস্তায় নামছে না কারণ তারা ভীত বা উদাসীন?
বাস্তব চিত্রটি আরও জটিল। ভারতীয় জেন-জি’র উত্থান নীরব নয়, তবে তা কোলাহলপূর্ণও নয়। তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ভাষায় (TBS, 2025) “বিদ্রোহী নয়, বরং বেশি সতর্ক” (more watchful than rebellious) একটি প্রজন্ম।
তারা জানে যে একটি ভুল পদক্ষেপ—একটি বেপরোয়া ফেসবুক পোস্ট বা একটি ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিবাদ—তাদের কষ্টার্জিত ক্যারিয়ারকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাপে পিষ্ট এবং একটি ‘ফোন-ভিত্তিক শৈশব’ (phone-based childhood)-এর মানসিক উদ্বেগের সাথে লড়াই করছে, যেমনটি অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৪-২৫ (PIB, 2025) উল্লেখ করেছে।
এই প্রজন্ম তাদের লড়াইয়ের জন্য ভিন্ন একটি পথ বেছে নিয়েছে। তারা সিস্টেমের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে না গিয়ে, সিস্টেমের মধ্যে থেকেই পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে। তারা purpose-driven (উদ্দেশ্য-চালিত) সংস্থায় কাজ করতে চায়, তারা পরিবেশ-সচেতন ব্র্যান্ডগুলিকে সমর্থন করে (Deloitte, 2024)। তারা তাদের ভোট দেওয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন এবং তাদের উদ্বেগগুলি (বেকারত্ব, সাম্প্রদায়িকতা) স্পষ্ট।
সুতরাং, ভারতীয় জেন-জি রাস্তায় নামছে না মানে এই নয় যে তারা চুপ করে আছে। তারা কথা বলছে, কিন্তু সেই কথা শোনার জন্য আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রেন্ড, অনলাইন পিটিশন এবং সর্বোপরি, তাদের অর্থনৈতিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের পরিসংখ্যানের দিকে কান পাততে হবে। তাদের নীরবতা উদাসীনতার নয়, বরং এক গভীর কৌশলগত বাস্তবতাবোধের পরিচায়ক।











