ভারতীয় উপমহাদেশ ইতিহাসের এক বিশাল পটভূমি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যার প্রতিটি দিনেই লুকিয়ে আছে নানা ঐতিহাসিক ঘটনা। ২২ শে জুন দিনটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এ দিনে ভারতের ইতিহাসে ঘটা কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরছি, যা ভারতের ইতিহাসে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে।
১৯৪৪: আজাদ হিন্দ ফৌজের মনিপুর অভিযান
সূচনা ও পরিকল্পনা
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ বা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (INA) ২২ শে জুন ১৯৪৪ সালে মনিপুর অভিযান শুরু করেছিল। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার লক্ষ্যে এই অভিযান পরিচালিত হয়।
অভিযান এবং ফলাফল
এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের কাছ থেকে মনিপুর পুনরুদ্ধার করা এবং স্বাধীন ভারতের প্রতিষ্ঠার দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। যদিও এই অভিযান পুরোপুরি সফল হয়নি, তবে এটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়।
১৯৪8: ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর যুদ্ধবিরতি
পটভূমি
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই কাশ্মীর অঞ্চলে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ২২ শে জুন ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।
যুদ্ধবিরতির শর্তাবলী
এই যুদ্ধবিরতির ফলে কাশ্মীর দুই ভাগে বিভক্ত হয় – ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীর এবং পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীর। এই যুদ্ধবিরতি লাইন পরবর্তীতে “লাইন অফ কন্ট্রোল” নামে পরিচিত হয়।
১৯৭৫: ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা ঘোষণা
প্রেক্ষাপট
২২ শে জুন ১৯৭৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন, যা পরের দিন কার্যকর হয়। এই জরুরি অবস্থা ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল।
জরুরি অবস্থার প্রভাব
জরুরি অবস্থার সময় মৌলিক অধিকার সীমাবদ্ধ করা হয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস পায়, এবং বিরোধী নেতাদের কারাগারে বন্দি করা হয়। এই সময়ের পর ইন্দিরা গান্ধীর জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায় এবং পরবর্তী নির্বাচনে কংগ্রেস দল পরাজিত হয়।
১৯৮৩: ভারতীয় ক্রিকেট দলের বিশ্বকাপ জয়
বিশ্বকাপ অভিযান
২২ শে জুন ১৯৮৩ সালে ভারতীয় ক্রিকেট দল কপিল দেবের নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতে নেয়। এই জয়ের মাধ্যমে ভারতীয় ক্রিকেটে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
ফাইনাল ম্যাচ
ফাইনাল ম্যাচে ভারতীয় দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ১৮৩ রান করে, যা ডিফেন্ড করার জন্য যথেষ্ট ছিল। মদন লাল এবং মহিন্দর অমরনাথের অসাধারণ বোলিং পারফরম্যান্সের কারণে ভারত ৪৩ রানে ম্যাচ জিতে বিশ্বকাপ অর্জন করে।
১৯৯১: রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর তদন্ত কমিশন রিপোর্ট
ঘটনার পটভূমি
১৯৯১ সালে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী তামিলনাড়ুতে এক নির্বাচনী প্রচারের সময় আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন। ২২ শে জুন ১৯৯১ সালে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য জাস্টিস জে.এস. ভার্মার নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠিত হয়।
কমিশনের প্রতিবেদন
এই কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে জানা যায় যে, শ্রীলঙ্কার এলটিটিই (Liberation Tigers of Tamil Eelam) সংগঠন এই হামলার পিছনে ছিল। এর ফলে এলটিটিই-এর বিরুদ্ধে ভারতের নীতি আরও কঠোর হয়ে ওঠে।
২০২০: ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষ
পটভূমি
২০২০ সালে ২২ শে জুন ভারত এবং চীনের মধ্যে লাদাখ সীমান্তে গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষ ঘটে। এই সংঘর্ষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২০ জন সৈনিক নিহত হন এবং চীনের তরফ থেকেও হতাহতের খবর পাওয়া যায়।
সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়া
এই সংঘর্ষের ফলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায় এবং কূটনৈতিক স্তরে আলোচনা শুরু হয়। ভারত-চীন সীমান্ত পরিস্থিতি এখনও অস্থির এবং দুই দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
১৯৫৭: অন্ধ্র প্রদেশের ভূমিসংস্কার আইন
ভূমিকা
২২ শে জুন ১৯৫৭ সালে অন্ধ্র প্রদেশ সরকারের উদ্যোগে ভূমিসংস্কার আইন প্রবর্তিত হয়। এই আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের জমির অধিকার নিশ্চিত করা এবং জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করা।
আইনের প্রভাব
এই আইনের ফলে অন্ধ্র প্রদেশের অনেক কৃষক জমির মালিকানা পান এবং তাদের জীবনের মান উন্নত হয়। এটি কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে এবং সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়।
১৯৮০: অপারেশন ব্লু স্টার
পটভূমি
১৯৮০ সালে ২২ শে জুন ভারতীয় সেনাবাহিনী পাঞ্জাবের স্বর্ণমন্দিরে অপারেশন ব্লু স্টার পরিচালনা করে। এই অপারেশনটির মূল উদ্দেশ্য ছিল খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নির্মূল করা, যারা স্বর্ণমন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিল।
অপারেশনের ফলাফল
অপারেশন ব্লু স্টার সফল হলেও এটি ভারতীয় ইতিহাসে একটি বিতর্কিত ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়। অনেক নিরীহ মানুষ এতে প্রাণ হারায় এবং পাঞ্জাবে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এই অপারেশনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১৯৮৪ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ড ঘটে।
২০০২: গুজরাটে গোধরা কাণ্ডের রায়
ঘটনার প্রেক্ষাপট
২০০২ সালে গুজরাটের গোধরা স্টেশনে একটি ট্রেনের বগিতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে, যা ভারত জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করে। ২২ শে জুন ২০০২ সালে এই ঘটনার তদন্ত শুরু হয়।
তদন্তের ফলাফল
বিভিন্ন তদন্ত কমিশন এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে জানা যায় যে, এই ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত ছিল এবং এর পিছনে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হাত ছিল। এই ঘটনার পর গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় এবং বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
যা না বললেই নয়
২২ শে জুন ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, যা বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়েছে। এই দিনটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, রাজনীতি, খেলাধুলা এবং কূটনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। ইতিহাসের পাতা থেকে এই ঘটনাগুলি আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে।