ভারতের শহুরে পরিবহন ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আসতে চলেছে। কেন্দ্রীয় আবাসন ও নগর বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী টোখান সাহু জানিয়েছেন যে, আগামী ৩-৪ বছরের মধ্যে ভারতের মেট্রো রেল নেটওয়ার্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম হয়ে উঠবে। এই অভূতপূর্ব অগ্রগতি দেশের শহুরে পরিবহন ব্যবস্থাকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বর্তমানে ভারতে ২৩টি শহরে মোট ৯৭৩ কিলোমিটার মেট্রো লাইন চালু রয়েছে। এর পাশাপাশি আরও ৯৮৫ কিলোমিটার মেট্রো লাইন নির্মাণাধীন রয়েছে। এই বিশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি যাত্রী যাতায়াত করছেন[2]। ২০১৪ সালের আগে মাত্র ৫টি শহরে ২৪৮ কিলোমিটার মেট্রো লাইন ছিল। গত ১০ বছরে এই নেটওয়ার্ক প্রায় ৭০০ কিলোমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।
Bangladesh Metro Rail: মেট্রো রেলের ক্ষতি দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন শেখ হাসিনা
সরকার শহুরে পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। বর্তমান সরকারের প্রথম ১০০ দিনের মধ্যেই তিনটি বড় মেট্রো প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। এগুলো হল – বেঙ্গালুরু মেট্রো ফেজ-৩, থানে ইন্টারনাল রিং রোড মেট্রো এবং পুণে মেট্রোর দক্ষিণ সম্প্রসারণ। এই তিনটি প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১,০০০ কোটি টাকা।
মন্ত্রী টোখান সাহু জানিয়েছেন, “আমরা খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি। আগামী ৩-৪ বছরের মধ্যে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাব এবং চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে থাকব।” তিনি আরও জানান, চীনের মেট্রো নেটওয়ার্ক ৮,০০০ কিলোমিটারের বেশি।
ভারতের মেট্রো নেটওয়ার্কের এই দ্রুত বিস্তার দেশের অর্থনীতি ও জনজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। এর ফলে:
১. যানজট কমবে: বড় শহরগুলোতে যানজটের সমস্যা অনেকটাই লাঘব হবে।
২. পরিবেশ দূষণ কমবে: কম কার্বন নির্গমনকারী পরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে মেট্রো রেল বায়ু দূষণ কমাতে সাহায্য করবে।
৩. সময় ও অর্থ সাশ্রয়: যাত্রীরা কম সময়ে ও কম খরচে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন।
৪. কর্মসংস্থান সৃষ্টি: মেট্রো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
৫. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: দ্রুত ও দক্ষ পরিবহন ব্যবস্থা শহরগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করবে।
লন্ডনের অন্ডারগ্রাউন্ড: বিশ্বের প্রথম মেট্রো যা ইতিহাস বদলে দিয়েছিল!
মেট্রো রেল প্রকল্পগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাই এগুলো বাস্তবায়নের আগে কেন্দ্রীয় সরকার সব দিক বিবেচনা করে সম্ভাব্যতা যাচাই করে এবং সম্পদের সঠিক বরাদ্দ নিশ্চিত করে। উত্তরপ্রদেশ থেকে নমো ভারত মেট্রো রেল প্রকল্পের বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্ট (DPR) জমা দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী সাহু।
রাজধানী দিল্লির মেট্রো নেটওয়ার্কও আরও সম্প্রসারিত হতে চলেছে। দিল্লি মেট্রোর ৫ম পর্যায়ে আরও ৩৫০ কিলোমিটার যোগ হবে। এর ফলে নয়ডা, গুরুগ্রাম, ফরিদাবাদসহ NCR এলাকার সাথে যোগাযোগ আরও সহজ হবে। দিল্লি সরকার সম্প্রতি রিঠালা-কন্ডলি মেট্রো প্রকল্প অনুমোদন করেছে। করোনা মহামারির কারণে এই প্রকল্প কিছুটা বিলম্বিত হয়েছিল।
ভারতের মেট্রো রেল নেটওয়ার্কের এই অভূতপূর্ব বিকাশ বিশ্বের কাছে একটি উদাহরণ হয়ে উঠছে। দিল্লি মেট্রো রেল কর্পোরেশন (DMRC) ইতিমধ্যে বাংলাদেশে মেট্রো রেল সিস্টেম বাস্তবায়ন করছে এবং জাকার্তায় পরামর্শক সেবা দিয়েছে। এছাড়া ইসরায়েল, সৌদি আরব (রিয়াদ), কেনিয়া ও এল সালভাদর DMRC-এর সাথে তাদের মেট্রো উন্নয়ন প্রকল্পে সহযোগিতা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
ভারতের মেট্রো রেল শিল্পের উন্নয়নে দেশীয় প্রযুক্তি ও দক্ষতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। গত পাঁচ বছরে দেশে চারটি অত্যাধুনিক মেট্রো কোচ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এই কারখানাগুলো ইতিমধ্যে ১,০০০টিরও বেশি মেট্রো কোচ তৈরি করেছে।
সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্তমানে ২৭টি শহরে মোট ৯৪৫ কিলোমিটার মেট্রো রেল বা রিজিওনাল র্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেম (RRTS) লাইন চালু রয়েছে। এর পাশাপাশি ৯৩৯ কিলোমিটার নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৬ কিলোমিটার নতুন মেট্রো/RRTS লাইন চালু হয়েছে। ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত চালু মেট্রো/RRTS লাইনগুলোতে দৈনিক যাত্রী সংখ্যা ছিল ১.০১ কোটি।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মেট্রো রেল ও MRTS প্রকল্পগুলোর জন্য মোট ২৪,৯৩১.৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে[3]। এটি আগের বছরের সংশোধিত বরাদ্দের তুলনায় ৭.৮% বেশি।
মেট্রো রেল নেটওয়ার্কের এই দ্রুত বিস্তার ভারতের শহুরে পরিবহন ব্যবস্থায় একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। এর ফলে শহরগুলো আরও বাসযোগ্য ও টেকসই হয়ে উঠছে। তবে এই বিশাল প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ। জমি অধিগ্রহণ, পরিবেশগত প্রভাব, অর্থায়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো সতর্কতার সাথে মোকাবেলা করতে হবে।
তবে সামগ্রিকভাবে, ভারতের মেট্রো রেল নেটওয়ার্কের এই অভূতপূর্ব বিকাশ দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে উঠেছে। আগামী কয়েক বছরে যখন এই নেটওয়ার্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে, তখন তা শুধু পরিসংখ্যানগত সাফল্যই হবে না, বরং ভারতের ক্রমবর্ধমান আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও বিশ্ব দরবারে বর্ধিত প্রভাবেরও প্রতীক হয়ে উঠবে।