77 Years of Flag Hoisting at Red Fort on Independence Day: প্রতিবছর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসে দিল্লির ঐতিহাসিক লালকেল্লার প্রাচীর থেকে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু লালকেল্লায় ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক সরিয়ে সেখানেই ভারতের ত্রিবর্ণ জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। তখন থেকেই চলে আসছে এই ঐতিহ্য, যা আজ ৭৭ বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, তাজমহল বা ফতেপুর সিক্রির মতো অন্যান্য মুঘল স্থাপত্য থাকতে কেন শুধুমাত্র লালকেল্লায়ই জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়?
স্বাধীনতার প্রথম দিনে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট প্রথমে নতুন দিল্লির ইন্ডিয়া গেটের কাছে প্রিন্সেস পার্কে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল। কিন্তু ঠিক তার একদিন পর অর্থাৎ ১৬ আগস্ট লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়। একদিন কেন দেরি হয়েছিল তা নিয়ে এখনও প্রশ্ন থেকে গিয়েছে। তবে ১৯৪৮ সাল থেকে প্রতিবছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে স্বাধীনতা দিবস পালন করেন।
লালকেল্লা নির্বাচনের পেছনে রয়েছে গভীর ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণ। ১৭ শতকে মুঘল সম্রাট শাহজাহান তাঁর শক্তি এবং মহিমার প্রতীক হিসেবে এই দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন। এই দুর্গটি ছিল ক্ষমতার কেন্দ্র এবং ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে কার্যকর ছিল। যেহেতু দিল্লি ভারতের সবথেকে শক্তিশালী রাজ্য ছিল, তাই লালকেল্লা থেকেই মুঘল সম্রাটরা রাজত্ব করতেন।
বঙ্গ রাজনীতির রঙিন মঞ্চে পাঁচ চরিত্র: কেউ রং ছড়ালেন, কেউ গৃহবন্দি জ্বরে
মুঘল শাসনের পর ব্রিটিশরা ক্ষমতায় এসে দুর্গটি দখল করে এবং এখান থেকে প্রায় ২০০ বছর ভারতের উপর শাসন করেছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশিক সরকার লালকেল্লায় তাদের পতাকা উত্তোলন করে শাসনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করত। এই কারণেই স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী নেহরু প্রতীকী অর্থে ব্রিটিশ পতাকা সরিয়ে ভারতীয় তেরঙ্গা উত্তোলন করেছিলেন।
লালকেল্লার সাথে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দীর্ঘ সম্পর্ক রয়েছে। এখান থেকেই মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু এবং সুভাষচন্দ্র বসু সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ভারতের জনগণকে স্বাধীনতার লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বক্তৃতা এবং সমাবেশ করতেন। দুর্গটি মাতৃভূমির জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বেশ কয়েকটি সংগ্রামের সাক্ষী হয়েছে।
লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার আরও বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, লালকেল্লা ভারতের সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের প্রতীক। দ্বিতীয়ত, লালকেল্লা হল একটি বৃহৎ মনমুগ্ধকর কাঠামো, যেখানে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান সহজেই উদযাপন করা যায়। তৃতীয়ত, এর অবস্থানও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং শক্তি ও মহিমার বার্তা দেয়।
প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ১৯৪৭ সালের ১৬ আগস্ট থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত একটানা ১৭ বছর ধরে লালকেল্লায় ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। তাঁর পর থেকে প্রতিটি প্রধানমন্ত্রী এই ঐতিহ্য অব্যাহত রেখেছেন। তবে দুজন প্রধানমন্ত্রী এমন রয়েছেন যাঁরা কখনও লালকেল্লায় তেরঙ্গা উত্তোলনের সুযোগ পাননি।
গুলজারিলাল নন্দা দু’বার দেশের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন—প্রথমবার ১৯৬৪ সালে জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর এবং দ্বিতীয়বার ১৯৬৬ সালে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর। দুই ক্ষেত্রেই তাঁর মেয়াদ ছিল মাত্র ১৩ দিনের মতো, ফলে কোনওবারই ১৫ আগস্ট তাঁর কার্যকালের মধ্যে পড়েনি। অন্যদিকে ভারতের অষ্টম প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর ১৯৯০ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৯১ সালের জুন পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তাঁর সরকার মাত্র ছয় মাসেই পতন হয়, সেই সময়ের মধ্যে স্বাধীনতা দিবস না পড়ার কারণে তিনিও কখনও লালকেল্লায় তেরঙ্গা উত্তোলন করতে পারেননি।
পাঁচবারের বেশি লালকেল্লায় পতাকা উত্তোলনকারী প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী (১১ বার), মনমোহন সিং (১০ বার), নরেন্দ্র মোদি (২০১৪ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে), অটল বিহারী বাজপেয়ী (৬ বার), রাজীব গান্ধী এবং নরসিংহ রাও (৫ বার করে)।
লালকেল্লায় একেবারে উপরে, লাহোরি গেটের উপরে সারা বছরই জাতীয় পতাকা ওড়ে। কেল্লার প্রাচীরে যেখানে স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়, সেটি একটি আলাদা স্থান। এই অনুষ্ঠানটি জাতীয় চ্যানেল দূরদর্শনের সাহায্যে সারা দেশে সম্প্রচারিত হয়।
লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন প্রতিটি ভারতীয়ের অনুভূতির প্রকাশ। পতাকা উত্তোলনকে শক্তির কেন্দ্র হিসেবে দেখা হত। এই স্থাপত্য ভারতের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের স্মারক বহন করে চলে। লালকেল্লার ইতিহাস এবং এর অবস্থান এটিকে অন্যান্য মুঘল স্থাপত্য এবং স্মৃতিস্তম্ভ থেকে আলাদা করে তোলে।
পিপিএফ ম্যাচিওর হয়ে গেলে আপনার সামনে থাকবে এই ৩টি সুবর্ণ সুযোগ
আজও যখন প্রধানমন্ত্রী লালকেল্লায় ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করেন, তখন প্রতিটি ভারতীয়, এমনকি অনাবাসীরাও, ব্রিটিশ শাসন থেকে দেশের স্বাধীনতার জন্য মানুষের ত্যাগের কথা স্মরণ করে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। এই ঐতিহ্য শুধুমাত্র একটি অনুষ্ঠান নয়, বরং দেশের স্বাধীনতা, গর্ব ও গণতন্ত্রের প্রতীক।
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে ভারতের সরকারি ও বেসরকারি ভবনগুলিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন একটি সাধারণ প্রথা। রাজ্য রাজধানীতেও পতাকা উত্তোলন সহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। অন্যান্য শহরে রাজনৈতিক নেতৃবর্গ নিজ নিজ কেন্দ্রে পতাকা উত্তোলন করেন।
লালকেল্লা নির্মাণের পর থেকে ভারতের ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বে জড়িত রয়েছে। সেটা মুঘল শাসনের পরাজয় এবং ব্রিটিশ শাসনের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠাই হোক বা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের বিদ্রোহই হোক। এই কারণেই প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে ভারত তার ঐতিহাসিক গৌরব ও স্বাধীনতার চেতনাকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে।