আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভারতীয় পাসপোর্টধারীদের জন্য এক উৎসাহব্যঞ্জক খবর এসেছে। হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স ২০২৫-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে ভারত তার সর্বকালের সবচেয়ে বড় অগ্রগতি অর্জন করেছে। গত বছরের ৮৫তম অবস্থান থেকে এক লাফে ৮ ধাপ এগিয়ে ভারত এখন ৭৭তম স্থানে রয়েছে। এই উন্নতির ফলে ভারতীয় নাগরিকরা এখন ৫৯টি দেশে ভিসা-মুক্ত অথবা ভিসা-অন-অ্যারাইভাল সুবিধা নিয়ে ভ্রমণ করতে পারবেন, যা গত বছরের ৫৭টি থেকে ২টি বেশি।
লন্ডন-ভিত্তিক বিশ্বব্যাপী গবেষণা সংস্থা হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স ২২ জুলাই প্রকাশিত এই সূচকে বিশ্বের ১০৬টি দেশের পাসপোর্টের শক্তি পরিমাপ করেছে। প্রতিটি দেশের পাসপোর্টধারীরা কতগুলি গন্তব্যে পূর্ববর্তী ভিসা ছাড়াই প্রবেশ করতে পারেন, সেই ভিত্তিতে এই র্যাঙ্কিং নির্ধারণ করা হয়। ভারতের এই অগ্রগতি দেশের ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক প্রভাব এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নতির একটি স্পষ্ট প্রমাণ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের এই র্যাঙ্কিং উন্নতি দেশের অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক কূটনীতিতে সক্রিয় ভূমিকার ফল। গত কয়েক বছরে ভারত বিভিন্ন দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশেষ করে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলির সাথে ভারতের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে। এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে ভিসা নীতিমালার উদারীকরণে।
এবারের তালিকায় নতুন যুক্ত হওয়া দেশগুলির মধ্যে ফিলিপিন্স অন্যতম। এই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশটি ভারতীয় পর্যটকদের জন্য ১৪ দিনের ভিসা-মুক্ত থাকার সুবিধা চালু করেছে। এছাড়া যেসব ভারতীয়দের কাছে বৈধ আমেরিকান, জাপানি, অস্ট্রেলিয়ান, কানাডিয়ান, শেঙ্গেন, সিঙ্গাপুর বা যুক্তরাজ্যের ভিসা রয়েছে, তারা ফিলিপিন্সে ৩০ দিন পর্যন্ত থাকতে পারবেন।
ভিসা-মুক্ত ভ্রমণের সুবিধা পেতে ভারতীয় পর্যটকরা এখন জনপ্রিয় গন্তব্য মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ এবং থাইল্যান্ডে যেতে পারেন। এই দেশগুলি বিশেষ করে ভারতীয় পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। থাইল্যান্ড ভারতীয়দের জন্য ৩০ দিনের ভিসা-মুক্ত থাকার সুবিধা দিয়েছে, যা নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছিল। মালয়েশিয়াও ভারতীয়দের জন্য ৩০ দিনের ভিসা-মুক্ত সুবিধা চালু রেখেছে।
পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা, ম্যাকাও, মায়ানমারের মতো দেশগুলিতে ভারতীয়রা ভিসা-অন-অ্যারাইভাল সুবিধা পাবেন। এর অর্থ হল, এই দেশগুলিতে পৌঁছানোর পর বিমানবন্দরেই ভিসা সংগ্রহ করা যাবে। এই পদ্ধতিতে আগে থেকে দূতাবাসে গিয়ে ভিসার জন্য আবেদন করার প্রয়োজন নেই।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নেপাল এবং ভুটানে ভারতীয়দের জন্য ভিসা-মুক্ত ভ্রমণের সুবিধা রয়েছে। এই দুটি দেশ ভারতের সাথে বিশেষ কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে এই সুবিধা প্রদান করে। নেপালে ভারতীয়রা সীমাহীনভাবে থাকতে পারেন, আর ভুটানে ১৪ দিনের সুবিধা রয়েছে।
আফ্রিকা মহাদেশে ভারতীয়দের জন্য কয়েকটি আকর্ষণীয় গন্তব্য রয়েছে। মরিশাস ৯০ দিনের ভিসা-মুক্ত থাকার সুবিধা দেয়। সেনেগাল, রুয়ান্ডা, কেনিয়া, সেশেলসের মতো দেশগুলিতেও ভারতীয়রা ভিসা ছাড়াই কিংবা ভিসা-অন-অ্যারাইভাল নিয়ে যেতে পারেন। এই দেশগুলি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাফারি পর্যটনের জন্য বিখ্যাত।
ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে বেশ কয়েকটি দ্বীপ দেশ ভারতীয়দের জন্য ভিসা-মুক্ত সুবিধা প্রদান করে। বার্বাডোস, ডোমিনিকা, গ্রেনাডা, জ্যামাইকা, ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে ভারতীয়রা বিনা ভিসায় ভ্রমণ করতে পারেন। এই দেশগুলি সমুদ্র সৈকত, সংস্কৃতি এবং ইকো-ট্যুরিজমের জন্য জনপ্রিয়।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ফিজি, ভানুয়াতু, কিরিবাতি, মাইক্রোনেশিয়ার মতো দ্বীপ দেশগুলিতেও ভারতীয়রা ভিসা-মুক্ত ভ্রমণ করতে পারেন। এই দেশগুলি প্রবাল প্রাচীর, ডাইভিং এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ভারতীয়দের জন্য ১৫ দিনের ভিসা-মুক্ত সুবিধা চালু করেছে। এছাড়া কাতার, জর্ডানে ভিসা-অন-অ্যারাইভাল সুবিধা রয়েছে। এই অঞ্চলে ব্যবসায়িক সফর এবং পর্যটনের জন্য এই সুবিধা বিশেষভাবে কার্যকর।
বিশ্বব্যাপী পাসপোর্ট র্যাঙ্কিংয়ে এবারও এশিয়ার আধিপত্য বজায় রয়েছে। সিঙ্গাপুর প্রথম স্থান অধিকার করে আছে, যার পাসপোর্টধারীরা ১৯৩টি দেশে ভিসা ছাড়াই প্রবেশ করতে পারেন। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ১৯০টি দেশের অ্যাক্সেস নিয়ে। তৃতীয় স্থানে রয়েছে ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেনসহ সাতটি ইউরোপীয় দেশ, যাদের পাসপোর্টে ১৮৯টি দেশের প্রবেশাধিকার রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য যে, এবার চীনও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। গত বছরের ৯৪তম স্থান থেকে চীন এবার ৬০তম স্থানে উঠে এসেছে। অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ৩৪ ধাপ এগিয়ে অষ্টম স্থানে পৌঁছেছে। একসময়ের শীর্ষস্থানীয় দেশ আমেরিকা এবং যুক্তরাজ্য বর্তমানে যথাক্রমে ষষ্ঠ ও দশম স্থানে রয়েছে।
ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে পাকিস্তান ১০৩তম স্থানে রয়েছে। এই তুলনায় ভারতের অবস্থান অনেক ভালো। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলিও ভারতের চেয়ে নিচের অবস্থানে রয়েছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের নেতৃত্বের অবস্থান তুলে ধরে।
তালিকার একেবারে নিচে রয়েছে আফগানিস্তান। আফগান পাসপোর্টধারীরা মাত্র ২৫টি দেশে ভিসা-মুক্ত প্রবেশাধিকার পান। এটি দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার প্রতিফলন।
ভারতীয় পর্যটকদের জন্য এই উন্নতি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। আগে যেখানে দূতাবাসে গিয়ে জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভিসার জন্য আবেদন করতে হতো, সেখানে এখন অনেক দেশে সহজেই ভ্রমণ করা যাবে। এতে ভ্রমণ খরচ কমবে এবং সময় সাশ্রয় হবে। বিশেষ করে স্বল্পমেয়াদী ছুটির পরিকল্পনা করা এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে।
ব্যবসায়িক দিক থেকেও এই উন্নতি গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীরা এখন দ্রুত এবং সহজে বিভিন্ন দেশে ব্যবসায়িক সফর করতে পারবেন। এতে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়তা মিলবে। স্টার্টআপ সংস্থাগুলি বিশেষভাবে এই সুবিধার সুফল পাবে।
শিক্ষার্থীদের জন্যও এই সুবিধা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। অনেক দেশে শিক্ষা মেলা, সেমিনার বা স্বল্পমেয়াদী কোর্সে অংশগ্রহণের জন্য এখন আর আগাম ভিসার ঝামেলা পোহাতে হবে না। গবেষণা কাজে যুক্ত শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা দ্রুত আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় অংশ নিতে পারবেন।
তবে ভিসা-মুক্ত ভ্রমণের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। প্রতিটি দেশের নিজস্ব নিয়মকানুন রয়েছে। থাকার সময়সীমা, ভ্রমণের উদ্দেশ্য, ফেরার টিকিট এবং আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ – এসব বিষয়ে প্রতিটি দেশের আলাদা আলাদা শর্ত থাকতে পারে। তাই ভ্রমণের আগে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের ওয়েবসাইট থেকে সর্বশেষ তথ্য জেনে নেওয়া উচিত।
পাসপোর্টের বৈধতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অধিকাংশ দেশ চায় যে পাসপোর্টের বৈধতা কমপক্ষে ছয় মাস থাকুক। এছাড়া পাসপোর্টে পর্যাপ্ত খালি পাতা থাকাও জরুরি। কিছু দেশ আগমনের সময় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ রাখার শর্ত আরোপ করে।
চিকিৎসা বিমার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে অনেক দেশ স্বাস্থ্য বিমা এবং টিকাদানের সার্টিফিকেট চায়। ভ্রমণকারীদের এই বিষয়গুলি আগে থেকেই প্রস্তুত রাখা উচিত।
ভবিষ্যতের দিকে তাকালে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের এই উর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকবে। দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তি, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং বৈশ্বিক কূটনীতিতে সক্রিয় ভূমিকার ফলে আরও বেশি দেশ ভারতীয়দের জন্য ভিসা নীতি শিথিল করতে পারে। এর ফলে আগামী কয়েক বছরে ভারতের পাসপোর্ট র্যাঙ্কিং আরও উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং মর্যাদা এই পাসপোর্ট র্যাঙ্কিং উন্নতির মূল কারণ। জি-২০ সভাপতিত্ব, জলবায়ু পরিবর্তনে নেতৃত্ব, ডিজিটাল প্রযুক্তিতে অগ্রগতি এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা – এসব কিছু মিলে ভারতের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উন্নত হয়েছে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে পাসপোর্টের শক্তিতে।