ভারত সরকার গত বছর আগস্ট মাস থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা সেবা ব্যাপকভাবে সীমিত করেছে, যার ফলে লাখ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক চরম দুর্ভোগের সম্মুখীন হচ্ছেন। বিশেষ করে চিকিৎসা, শিক্ষা এবং পর্যটন উদ্দেশ্যে ভারত যাওয়া বাংলাদেশিদের জন্য এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে শুধুমাত্র জরুরি মেডিকেল এবং মানবিক কারণে সীমিত সংখ্যক ভিসা ইস্যু করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত বছর আগস্টে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নিরাপত্তার স্বার্থে ভারতীয় হাইকমিশন সাময়িকভাবে ভিসা সেবা বন্ধ করে দিয়েছিল। সেপ্টেম্বরে ব্যাপক বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন ২০,০০০ এর বেশি বাংলাদেশি পাসপোর্ট ফেরত দিয়েছিল1। এরপর থেকে দৈনিক ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্টের সংখ্যা ৭,০০০ থেকে কমে ৫০০-৭০০ হয়ে গেছে, যা বাংলাদেশিদের জন্য ভারত ভ্রমণকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে।
জানুয়ারি মাস থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট এবং খুলনায় পাঁচটি ভিসা কেন্দ্র সীমিত আকারে কার্যক্রম শুরু করেছে, কিন্তু শুধুমাত্র জরুরি এবং মানবিক কারণে আবেদন গ্রহণ করা হচ্ছে1। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জৈসওয়াল বলেছেন, “আমরা পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছি এবং যখন স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে, তখন আমরা পূর্ণাঙ্গ ভিসা কার্যক্রম শুরু করব”।
চিকিৎসা পর্যটন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ রোগী ভারতে চিকিৎসার জন্য যান। ২০২৩ সালে ভারত বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ২০ লাখেরও বেশি ভিসা ইস্যু করেছিল, যার অধিকাংশই ছিল মেডিকেল ভিসা। কিন্তু বর্তমানে দৈনিক মেডিকেল ভিসার সংখ্যা ১,০০০ এরও কম হয়ে গেছে, যেখানে আগে প্রতিদিন ৫,০০০ থেকে ৭,০০০ ভিসা ইস্যু করা হতো।
কেয়ারএজ রেটিংস, একটি জ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণমূলক গ্রুপের মতে, ভারতের প্রধান হাসপাতালগুলোতে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা ২৫% থেকে ৪০% পর্যন্ত কমে গেছে1। বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে হাজার হাজার বাংলাদেশি রোগী যারা ভারতের সাশ্রয়ী মূল্যের চিকিৎসা সেবার উপর নির্ভরশীল ছিলেন, তারা এখন থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং তুরস্কের মতো বিকল্প দেশগুলিতে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
“দেশগুলোর মধ্যে চলাচলে বাধা সৃষ্টি হওয়া প্রায়ই রাজনৈতিক মতপার্থক্যের ফলাফল। ভারত এবং বাংলাদেশকে একাধিক সমস্যা সমাধানের জন্য দীর্ঘ আলাপ-আলোচনায় প্রবেশ করতে হবে,” পাকিস্তানে সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত অজয় বিশারিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেছেন।
শিক্ষার্থীদের জন্যও এই পরিস্থিতি অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফিনল্যান্ড, রোমানিয়া এবং চেক প্রজাতন্ত্রের মতো ইউরোপীয় দেশগুলোতে পড়াশোনা করতে ইচ্ছুক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা বর্তমানে ভিসা প্রক্রিয়াকরণ সমস্যার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন1। অনেক দেশের বাংলাদেশে দূতাবাস না থাকায়, শিক্ষার্থীদের ভিসা আবেদন জমা দেওয়ার জন্য ভারতে যেতে হয়। এই প্রয়োজনীয়তা এখন একটি লজিস্টিক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে, কারণ অনেক শিক্ষার্থী ভারতীয় ভিসা পেতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
২০২৪ সালের আগস্টে ভারতীয় ভিসা কেন্দ্র “সীমিত কার্যক্রম” পুনরায় শুরু করার পরে, ঢাকায় ভিসা প্রক্রিয়াকরণে বিলম্বের কারণে বড় আকারের বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল6। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া বেশ কয়েকটি ভিডিওতে ক্রুদ্ধ ভিসা আবেদনকারীদের স্লোগান দিতে এবং বিলম্ব ও ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে কথিত হয়রানির কারণে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দেখা গিয়েছিল6। বিক্ষোভকারীরা দাবি করেছিলেন যে মাসের পর মাস অপেক্ষা করার পরেও তারা ভিসা পাননি।
ভারতের ভিসা সীমাবদ্ধতার কারণে চীন বাংলাদেশে নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছে57। “যখন একটি শূন্যতা থাকে, তখন অন্যরা সেই শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে আসে,” বাংলাদেশের একজন কূটনীতিক রয়টার্সকে জানিয়েছেন। “কিছু লোক থাইল্যান্ড এবং চীনে যাচ্ছে।” বাংলাদেশি রোগীদের জন্য ভারতের সাশ্রয়ী ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এবং বাংলা ভাষাভাষী মেডিকেল স্টাফ দীর্ঘদিন ধরে আকর্ষণীয় ছিল, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করতে সাহায্য করেছিল।
ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা সম্প্রতি বাংলাদেশিদের জন্য পর্যটক ভিসা “অদূর ভবিষ্যতে” পুনরায় শুরু না করার ভারতের অবস্থান পুনরায় স্পষ্ট করেছেন3। তিনি বলেছেন যে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন শুধুমাত্র জরুরি ক্ষেত্রে ভিসা ইস্যু করছে। তিনি জনশক্তির অভাবকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন যে হাইকমিশন মেডিকেল উদ্দেশ্যে জরুরি ভিত্তিতে যাদের ভিসা প্রয়োজন তাদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
কোভিড-১৯ মহামারীর পূর্বে, ২০১৯ সালে ভারত বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ১৬ লক্ষেরও বেশি ভিসা ইস্যু করেছিল, যা ভারতীয় ভিসা ইস্যুর বৃহত্তম সংখ্যা ছিল9। ভারতের ভিসা সেবা বাংলাদেশে বিশ্বের বৃহত্তম ভিসা অপারেশন নেটওয়ার্ক, যেখানে বাংলাদেশ জুড়ে ১৫টি ভারতীয় ভিসা কেন্দ্র ছড়িয়ে আছে।
দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও অবনতি হয়েছে সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ইস্যু নিয়ে। সীমান্তে বেড়া নির্মাণের অভিযোগের পরেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করেছিল1। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে এবং পূর্ণাঙ্গ ভিসা সেবা পুনরায় শুরু করতে আরও সময় লাগতে পারে, যা বাংলাদেশের হাজার হাজার নাগরিকের জন্য চিকিৎসা, শিক্ষা এবং পর্যটন সুবিধার ক্ষেত্রে অব্যাহত দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।