Traditional New Year festivals in India: ভারতবর্ষে নববর্ষ কেবল একদিন বা একভাবে উদযাপিত হয় না। এই বিশাল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভিন্ন ভিন্ন নামে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন রীতি-নীতি অনুসরণ করে নববর্ষ পালিত হয়। আশ্চর্যজনকভাবে, ভারতের অধিকাংশ রাজ্যের পারম্পরিক নববর্ষ এপ্রিল মাসেই পড়ে, যেটি প্রাচীন হিন্দু লুনি-সোলার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী চৈত্র বা বৈশাখ মাসের শুরুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ফসল সংগ্রহের মৌসুমের সাথে মিলে যাওয়া এই উৎসবগুলি শুধু ধর্মীয় তাৎপর্যই বহন করে না, বরং নতুন বছরের শুরু, শস্য সংগ্রহের আনন্দ এবং নতুন সম্ভাবনার প্রতিও ইঙ্গিত করে।
উত্তর ভারতের নববর্ষ উদযাপন
বৈশাখী (পঞ্জাব)
পঞ্জাবে বৈশাখী হল সবচেয়ে বড় ফসল উৎসব, যা সমগ্র উত্তর ভারতে পালিত হয়। এই উৎসব প্রতি বছর ১৩ বা ১৪ এপ্রিল তারিখে উদযাপিত হয়। বৈশাখ মাসের প্রথম দিনকে স্মরণ করে এই দিনটি শিখ সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, কারণ এদিনে শিখ খালসার প্রতিষ্ঠা স্মরণ করা হয়। উৎসবের মূল আয়োজন হয় খালসার জন্মস্থান এবং অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে।
বৈশাখী উদযাপনে ভাঙ্গড়া নৃত্য এবং ঢোলের (ঐতিহ্যবাহী ঢাক) তালে তালে উত্সব-মুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। রঙিন পোশাক পরিহিত মানুষজন উৎসাহভরে এই দিনটি উদযাপন করে, যা পাঞ্জাবি সংস্কৃতির প্রাণবন্ত চিত্র তুলে ধরে।
জুড়ে শীতল (বিহার, ঝাড়খণ্ড)
মৈথিলি নববর্ষ নামেও পরিচিত এই উৎসব বিহার, ঝাড়খণ্ড এমনকি নেপালের মৈথিলি সম্প্রদায়ের মানুষেরা পালন করেন। গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী সাধারণত ১৪ এপ্রিল তারিখে এই উৎসব উদযাপিত হয়। এটি মৈথিলি সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, যাতে পারিবারিক মিলনমেলা, বিশেষ খাবার তৈরি এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত।
পূর্ব ভারতের নববর্ষ উদযাপন
পহেলা বৈশাখ (পশ্চিমবঙ্গ)
পশ্চিমবঙ্গে বাংলা নববর্ষকে ‘পয়লা বৈশাখ’ বা ‘পহেলা বৈশাখ’ নামে অভিহিত করা হয়, যা বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বৈশাখ মাসের প্রথম দিন। এটি সাধারণত ১৪ বা ১৫ এপ্রিল তারিখে পড়ে7। এদিন রাজ্যজুড়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নতুন পোশাক কেনাকাটা এবং সঙ্গীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শান্তিনিকেতন ‘নবোবর্ষো’ (নববর্ষ) উৎসবের জন্য বিখ্যাত, যেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নৃত্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।
বাঙালিরা এদিন “শুভ নববর্ষ” বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন, পরিবারের সদস্যদের সাথে মিলিত হন, এবং নতুন বছরের সূচনায় মিষ্টিমুখ করান। অনেকে ঐতিহ্যগত পোশাক পরে বাড়ি সাজান এবং বিশেষ খাবার প্রস্তুত করেন।
বোহাগ বিহু (আসাম ও উত্তর-পূর্ব রাজ্য)
আসাম এবং উত্তর-পূর্বের অন্যান্য রাজ্যে বোহাগ বিহু অসমীয়া নববর্ষ হিসেবে অত্যন্ত আনন্দের সাথে উদযাপিত হয়। এই উৎসবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, এবং বড় ভোজের আয়োজন করা হয়। বিহু নৃত্য ঢোল, পেপা, এবং গোগোনার সুরে পরিবেশিত হয়।
এই উৎসব উদযাপনে গৃহ পরিষ্কার, পিঠা নামক বিশেষ খাবার তৈরি, এবং বড়দের আশীর্বাদ নেওয়ার মতো রীতি-নীতি অন্তর্ভুক্ত। বোহাগ বিহু আসামের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা প্রকৃতি, কৃষি এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ককে তুলে ধরে।
নেপালি নববর্ষ (নেপালি-ভাষী সম্প্রদায়)
সিকিম, দার্জিলিং এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের নেপালি-ভাষী সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘নয়া বর্ষ’ বা ‘বিক্রম সংবৎ নববর্ষ’ নামে এই উৎসব পালিত হয়। প্রতি বছর ১৩ বা ১৪ এপ্রিল তারিখে এই উৎসব উদযাপিত হয়। দিনটি মন্দির দর্শন, সম্প্রদায় মিলনমেলা, এবং ঐতিহ্যবাহী নৃত্যের মাধ্যমে উদযাপিত হয়।
লোকেরা একে অপরকে “নয়া বর্ষকো শুভকামনা” বলে শুভেচ্ছা জানায় এবং স্থানীয় মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। ঘরে ঘরে নেপালি ঐতিহ্যবাহী খাবার এবং মিষ্টি তৈরি করা হয়, এবং শিশুরা বড়দের কাছ থেকে উপহার পায়।
দক্ষিণ ভারতের নববর্ষ উদযাপন
উগাদি (কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ)
উগাদি তেলুগু এবং কন্নড় ভাষাভাষী লোকেদের জন্য ঐতিহ্যবাহী নববর্ষ। এটি চৈত্র শুদ্ধ পাদ্যমী, অর্থাৎ হিন্দু লুনিসোলার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রথম হিন্দু মাস চৈত্রের প্রথম দিনে উদযাপিত হয়। ‘উগাদি’ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘যুগাদি’ থেকে এসেছে, যার অর্থ একটি নতুন যুগের শুরু।
তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, এবং কর্ণাটকের মানুষেরা তাদের বাড়ি আম পাতা এবং গেঁদাফুল দিয়ে সাজিয়ে নববর্ষকে স্বাগত জানায়। উগাদি পাচাদি, ছয়টি বিভিন্ন স্বাদের একটি মিশ্রণ যা জীবনের বিভিন্ন আবেগকে প্রতীকায়িত করে, এই রাজ্যগুলিতে নববর্ষের রীতি-নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
বিশু (কেরালা)
কেরালায় মালায়ালম নববর্ষ বিশু নামে পরিচিত, যা কেরালা এবং তামিলনাড়ুর কিছু অংশে উদযাপিত হয়। এটি প্রতি বছর ১৪ বা ১৫ এপ্রিল তারিখে বসন্ত বিষুব দিনে পালিত হয়। ‘বিশু’ শব্দের অর্থ ‘সমান’, যা প্রকৃতিতে ভারসাম্যকে প্রতীকায়িত করে।
বিশুক্কানি (প্রথম দৃষ্টি) এই উৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি, যেখানে সোনালি ফুল, ফল, চাল, এবং মুদ্রা পূজা ঘরে সাজানো হয়। ভোরবেলায় এই জিনিসগুলি দেখা সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে বলে বিশ্বাস করা হয়। কাইনেট্টাম (উপহার) রীতিতে বড়রা শিশুদের আশীর্বাদের জন্য মুদ্রা বা টাকা বিতরণ করেন।
উৎসবে আতশবাজি, সাংস্কৃতিক নৃত্য, এবং সঙ্গীত অন্তর্ভুক্ত। বিশেষ সাধ্য ভোজও আয়োজন করা হয়, যেখানে কলা চিপস, তরকারি, এবং ভাত দিয়ে তৈরি খাবার কলার পাতায় পরিবেশন করা হয়।
পুথান্ডু (তামিলনাড়ু)
তামিলনাড়ুতে তামিল নববর্ষ পুথান্ডু নামে পরিচিত, যা প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল উদযাপিত হয়। এটি নতুন শুরু এবং সমৃদ্ধির প্রতীক। পুথান্ডু লর্ড ব্রহ্মার বিশ্বসৃষ্টির সাথেও সম্পর্কিত।
বিশ্বরূপ দর্শনম্ রীতিতে আম, নিম ফুল, সোনা, এবং মুদ্রার মতো শুভ উপকরণের ট্রে দেখা হয়। মানুষ দেবতাদের কাছে প্রার্থনা নিবেদন করে এবং বেপ্পাম পু রসম এবং ডাল পোলির মতো উৎসবের খাবার তৈরি করে।
সংগীত, নৃত্য, এবং উৎসবের সাজসজ্জা উদযাপনকে আরও সমৃদ্ধ করে। তামিলরা ঘর পরিষ্কার করে, নতুন পোশাক পরে, এবং কোলাম (চাল গুঁড়ো দিয়ে তৈরি রঙোলি) দিয়ে ঘর সাজায়।
পশ্চিম ভারতের নববর্ষ উদযাপন
গুড়ি পাড়ওয়া (মহারাষ্ট্র)
মহারাষ্ট্রে গুড়ি পাড়ওয়া নববর্ষ চিহ্নিত করে এবং বসন্তের আগমন বোঝায়। উৎসবের শুরু হয় একটি গুড়ি (উপরে পিতলের পাত্র সহ একটি সাজানো খুঁটি) বাড়ির বাইরে স্থাপন করে। দিনটিতে উৎসবের খাবার, সঙ্গীত, নৃত্য, এবং পারিবারিক একতা উপভোগ করা হয়।
মহারাষ্ট্রিয়ানরা এদিন বাড়ি পরিষ্কার করে, নতুন পোশাক পরে, এবং পরিবারের সাথে সময় কাটায়। গৃহের প্রবেশপথে রঙিন রঙোলি আঁকা হয় এবং আম পাতা দিয়ে দরজা সাজানো হয়।
নববর্ষ উদযাপনের অর্থনৈতিক প্রভাব
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নববর্ষ উদযাপন শুধু সাংস্কৃতিক উৎসব নয়, বরং এর বিশাল অর্থনৈতিক প্রভাবও রয়েছে। উৎসবের সময় বিশেষ করে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প উদ্যোগ (MSME) সেক্টর থেকে উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।
বিভিন্ন স্থানীয় হস্তশিল্পী, দর্জি, এবং জুয়েলারিদের ব্যবসায় উৎসবের সময় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয়। মানুষ নতুন পোশাক, অ্যাকসেসরিজ, গহনা, সাজসজ্জার সামগ্রী, উপহার ইত্যাদি কিনতে উৎসাহী হয়, যা প্রায় ৩,০০০ কোটি টাকার রাজস্ব তৈরি করে। একইভাবে, পরিবহন ও থাকার ব্যবস্থার চাহিদাও বৃদ্ধি পায়, যা প্রায় ২,০০০ কোটি টাকার রাজস্ব উৎপন্ন করে এবং স্থানীয় পর্যটনকে উৎসাহিত করে।
অলঙ্করণ এবং মিষ্টি জাতীয় পণ্যের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। উল্লেখযোগ্যভাবে, MSME-রা উৎসবের সময় বিক্রয় বাড়াতে ফ্লিপকার্ট, আমাজন এবং মিশো-র মতো প্ল্যাটফর্মগুলিকে ব্যবহার করছে।
নববর্ষ উদযাপনে সামাজিক ও পারিবারিক মিলনের গুরুত্ব
নববর্ষ উদযাপন কেবল সাংস্কৃতিক রীতিনীতি পালন নয়, এটি পারিবারিক বন্ধন মজবুত করার এবং বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক নবায়ন করার সময়ও বটে। এই সময়ে পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়ে বিশেষ খাবার তৈরি করে এবং একসাথে ভোজন উপভোগ করে।
বিভিন্ন রাজ্যের নববর্ষ উদযাপনে উপহার বিনিময় একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি। এটি নববর্ষে শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ প্রদানের এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখার একটি উপায়। উপহারগুলি মিষ্টি ও শুকনো ফল থেকে শুরু করে নতুন পোশাক এবং সাজসজ্জার আইটেম পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে।
সমস্ত নববর্ষ উদযাপনের সাধারণ সূত্র
যদিও নাম, রীতিনীতি, এবং খাবার-দাবার ভিন্ন হতে পারে, এই সমস্ত নববর্ষ উদযাপনের মূল ভাবনা একই রয়ে যায় – আশা, নবায়ন, এবং আনন্দ। আসামে পিঠার সুগন্ধ হোক, পাঞ্জাবে ঢোলের তাল হোক, বা তামিলনাড়ুতে কোলামের দৃশ্য হোক, প্রতিটি উদযাপন ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সারমর্ম বহন করে।
নববর্ষ হল আনন্দ উদযাপনের একটি সময়, কিন্তু এটি আত্ম-প্রতিফলন এবং আধ্যাত্মিক নবায়নের সময়ও বটে। এটি অতীতকে পেছনে ফেলে নতুন করে শুরু করার সময়। এই উৎসবগুলি বছরের পর বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে, ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বহন করে।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পালিত নববর্ষগুলি দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্যের একটি জীবন্ত প্রমাণ। New Year উদযাপনের এই বিভিন্ন রূপগুলি ভারতের বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক পরিচয়কে তুলে ধরে। নামগুলি ভিন্ন হলেও – বৈশাখী, পহেলা বৈশাখ, উগাদি, পুথান্ডু, বিশু, বোহাগ বিহু, গুড়ি পাড়ওয়া – সবগুলিরই মূল উদ্দেশ্য একই: নতুন শুরু, পুনর্নবীকরণ, এবং সমৃদ্ধির জন্য আশীর্বাদ চাওয়া।প্রতিটি উৎসবের মধ্যে দিয়ে আমরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের জীবনধারা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে অনুভব করতে পারি। এই বিভিন্ন নববর্ষ উদযাপনগুলি শুধুমাত্র উত্সব নয়, বরং এগুলি ভারতের বহুত্ববাদী ঐতিহ্যের সঙ্গে একাত্মতার প্রতীক, যা ‘ভিন্নতার মধ্যে ঐক্য’ এর মূল্যবোধকে তুলে ধরে।