Economic downturn in India : প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের (EAC-PM) একটি সাম্প্রতিক কর্মপত্রে উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে। রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, গত ৬০ বছরে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি ক্রমাগত অবনতির পথে। একসময় যে রাজ্য ভারতের জিডিপিতে তৃতীয় বৃহত্তম অবদানকারী ছিল, সেই রাজ্যের অবস্থান এখন অনেক নিচে নেমে গেছে।১৯৬০-৬১ সালে দেশের মোট জিডিপিতে পশ্চিমবঙ্গের অবদান ছিল ১০.৫ শতাংশ।
কিন্তু ২০২৩-২৪ সালে সেই অবদান কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫.৬ শতাংশে। এই ৬০ বছরে রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থানের ক্রমাগত অবনতি ঘটেছে। শুধু তাই নয়, মাথাপিছু আয়েরও বড় পতন ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৬০-৬১ সালে জাতীয় গড়ের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের মাথাপিছু আয় ছিল ১২৭.৫ শতাংশ। কিন্তু ২০২৩-২৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮৩.৭ শতাংশে।
Economics as a Subject: অর্থনীতির শিক্ষা সুযোগ, ক্যারিয়ার সম্ভাবনা [ এক নজরে ]
এর ফলে রাজস্থান এবং ওড়িশার মতো ঐতিহ্যগতভাবে পিছিয়ে পড়া রাজ্যের পেছনেও চলে গেছে পশ্চিমবঙ্গ।EAC-PM-এর সদস্য সঞ্জীব সান্যাল-এর লেখা এই কর্মপত্রে বলা হয়েছে, “পশ্চিমবঙ্গ, যা ১৯৬০-৬১ সালে জাতীয় জিডিপির তৃতীয় বৃহত্তম অংশ ধারণ করত (১০.৫ শতাংশ), এখন ২০২৩-২৪ সালে মাত্র ৫.৬ শতাংশ অবদান রাখছে। এই সময়কালে রাজ্যটি ধারাবাহিক অবনতি দেখেছে।”রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, “১৯৬০-৬১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মাথাপিছু আয় জাতীয় গড়ের ১২৭.৫ শতাংশ ছিল, কিন্তু তার বৃদ্ধি জাতীয় প্রবণতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি। ফলস্বরূপ, ২০২৩-২৪ সালে তার আপেক্ষিক মাথাপিছু আয় কমে ৮৩.৭ শতাংশে নেমে এসেছে, যা এমনকি ঐতিহ্যগতভাবে পিছিয়ে পড়া রাজ্য যেমন রাজস্থান এবং ওড়িশার চেয়েও কম।”
এই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের পতনের সূত্রপাত হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। ১৯৬০-এর দশক থেকেই রাজ্যের অর্থনীতি পিছিয়ে পড়তে শুরু করে। ১৯৯১ সালের অর্থনৈতিক উদারীকরণের পরও রাজ্যের অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। বরং অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান আরও খারাপ হয়েছে।রিপোর্টে বলা হয়েছে, দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি ১৯৯১ সালের পর থেকে অর্থনৈতিক উদারীকরণের সুযোগ কাজে লাগিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেছে। কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কেরালা এবং তামিলনাড়ু – এই পাঁচটি রাজ্য মিলে ২০২৩-২৪ সালে ভারতের জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ অবদান রাখছে। অথচ পশ্চিমবঙ্গ সেই সময় থেকেই পিছিয়ে পড়তে শুরু করে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পশ্চিমবঙ্গের এই অবনতির পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে:
১. শিল্প বিরোধী পরিবেশ:
১৯৬০ এর দশক থেকেই রাজ্যে শিল্প বিরোধী পরিবেশ তৈরি হতে শুরু করে। ট্রেড ইউনিয়নগুলির অতিরিক্ত আন্দোলন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বড় শিল্পগুলি রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে।
২. কৃষি ক্ষেত্রে স্থবিরতা:
কৃষি ক্ষেত্রে যথাযথ আধুনিকীকরণ এবং উন্নয়ন না হওয়ায় এই ক্ষেত্রেও রাজ্য পিছিয়ে পড়ে।
৩. পরিকাঠামোগত সমস্যা:
রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, বন্দর ইত্যাদি পরিকাঠামোগত ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নয়ন না হওয়ায় শিল্প বিকাশে বাধা সৃষ্টি হয়।
৪. দক্ষ জনশক্তির অভাব:
উচ্চশিক্ষা এবং দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দেওয়ায় দক্ষ জনশক্তির অভাব দেখা দেয়।
৫. রাজনৈতিক অস্থিরতা:
দীর্ঘদিন ধরে রাজ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করায় দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
এই অবস্থার প্রভাব পড়েছে রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়নে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য – সব ক্ষেত্রেই রাজ্য পিছিয়ে পড়েছে। ফলে যুব সমাজের একটা বড় অংশ কাজের সন্ধানে অন্য রাজ্যে পাড়ি জমাচ্ছে।তবে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে রাজ্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। শিল্প সম্মেলন আয়োজন, বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করার চেষ্টা, পরিকাঠামো উন্নয়নে জোর দেওয়া হচ্ছে।
তৃণমূলের একচ্ছত্র আধিপত্য, অন্ধকার ছায়া পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে!
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দীর্ঘদিনের অবনতি কাটিয়ে উঠতে আরও সময় লাগবে।অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। শিল্প, কৃষি, শিক্ষা – সব ক্ষেত্রেই সমন্বিত উন্নয়ন প্রয়োজন। বিশেষ করে উচ্চ প্রযুক্তি ভিত্তিক শিল্প এবং পরিষেবা ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে।”রাজ্য সরকারের একজন শীর্ষ আধিকারিক জানিয়েছেন, “আমরা সচেতন যে রাজ্যের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। সেজন্য নতুন শিল্পনীতি ঘোষণা করা হয়েছে, বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। পরিকাঠামো উন্নয়নেও জোর দেওয়া হচ্ছে। আশা করছি আগামী কয়েক বছরে ফল পাওয়া যাবে।”
তবে বিরোধী দলের নেতারা মনে করছেন, রাজ্য সরকারের পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। তাঁরা বলছেন, “শুধু ঘোষণা দিয়ে হবে না, বাস্তবায়ন দরকার। শিল্পায়নের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দুর্নীতি দূর করে স্বচ্ছতা আনতে হবে।”সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি এখন একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। দীর্ঘদিনের অবনতি কাটিয়ে উঠতে দরকার সুচিন্তিত পরিকল্পনা এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন। রাজ্যের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলিকে কাজে লাগিয়ে নতুন করে অর্থনৈতিক গতি আনতে হবে। তবেই সম্ভব হবে একসময়ের অগ্রণী রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে আনা।